একতা ডেস্ক :
কমরেড মোহাম্মদ নবী ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও পার্টির কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারম্যান। পার্টির জন্য তিনি নানারকম ঝুঁকি নিয়ে সারাজীবন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। পাকিস্তান আমলে যখন পার্টি নিষিদ্ধ ছিল তখন পার্টির নেতারা গোপন আস্তানায় থাকতেন, সেই আস্তানাগুলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আস্তানায় অধিকারী ছিলেন তিনি।
সাত বছর আগে ২০১৮ সালের ১৪ জানুয়ারি বিকেল ৩টায় ঢাকার নিজ বাসভবনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। দীর্ঘদিন তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন।
মোহাম্মদ নবীর জন্ম ইংরেজি ১৯২৬ সালে। ম্যাট্রিক সার্টিফিকেটে তারিখ দেওয়া আছে ৫ই মে। পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি কনিষ্ঠ। বাবা মাজহার আলী শেখ এবং মা কাজিমুন্নেসা। মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার গোপালপুর গ্রামে জন্ম নেয় এই লেখক। মাত্র ১৪ বছর বয়সে পিতা-মাতা উভয়কেই হারান। শিক্ষার সুযোগ সে সময়ে ছিল অপ্রতুল আর মুসলমান পরিবারের ছেলেদের জন্য সংকীর্ণতর। বাউন্ডুলেপনার সাথে সাথে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। তার লেখা “আমার কিছুকথা” বইটিতে তার বেড়ে ওঠার কাহিনী তৎকালীন দিশেহারা বাঙালি মুসলিম পরিবারগুলির তরুণদের চিত্র ফুঁটে উঠেছে।
কমরেড মোহাম্মদ নবী ছাত্র অবস্থায় কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হন। ব্রিটিশবিরোধী লড়াই, মুক্তিযুদ্ধসহ এদেশের শোষণ মুক্তির সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগামী। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তিনি বিশিষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। আজীবন বিপ্লবী মো. নবী কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে পার্টির কেন্দ্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পার্টির কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
দেশভাগের সময়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শরিক হওয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবনের শুরু। ক্রমশ বামপন্থি আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়া এবং কমিউনিস্ট পার্টির নিয়মিত সদস্য হিসেবে সক্রিয় হয়ে পড়লেন। ১৯৫০ সালে দুই বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পূর্ব বাংলার হিন্দু কমিউনিস্ট কর্মীরা বহু সংখ্যায় পশ্চিম বাংলায় চলে যেতে বাধ্য হন এবং পূর্ব বাংলায় কর্মীর অভাব দেখা দেয়। পার্টির নির্দেশে মুসলমান কর্মী হিসেবে ঢাকায় চলে আসেন ছাত্রাবস্থায় এবং সেই থেকে পার্টির বহু গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থেকেছেন। ১৯৫৫ সালে বিয়ে করেন। তার স্ত্রী প্রয়াত প্রখ্যাত নারী নেত্রী বেলা নবী। তিনিও বাংলাদেশের নারী ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। তাদের চার সন্তান। সকলেই উচ্চ শিক্ষিত এবং বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ছিলেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর সিপিবিতে বিলোপবাদীরা যে চক্রান্ত করে, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন কমরেড নবী। নিষ্ঠাবান, সদালাপী বলে পরিচিত কমরেড নবী পার্টির নেতাকর্মীদের সহজেই আপন করে নিতে পারতেন। কমিউনিস্ট আন্দোলনের পাশাপাশি তিনি শান্তি আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কমরেড নবীর মৃত্যুতে এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন এক পরীক্ষিত সৈনিক। সমাজপ্রগতির লড়াইকে অগ্রসর করতে কমরেড মোহাম্মদ নবীর জীবন ও সংগ্রাম থেকে বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মীদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
মোহাম্মদ নবী আমাদের দেশে বামপন্থি আন্দোলনের নেতাদের কাছে খুবই পরিচিত নাম, ব্যক্তিগত জীবনে সদালাপী, সুদর্শন এই মানুষটি ছিলেন নিজ আদর্শের অবিচল আস্থা রাখার জন্য সকলের সম্মানের পাত্র।
মিশুক ও আলাপচারী মোহাম্মদ নবীর গল্প বলার ধরনটি ছিল অত্যন্ত সাবলীল। সাধারণ বিষয়ের মধ্যে তিনি খুঁজে পান নানা অনুপ্রেণরার উৎস। তার শখ ছিল ঘুরে বেড়ানো এবং সুযোগ পেলেই সেই শখ পূরণও করেছেন তিনি। মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, কথা বলেছেন, তাদের নানা ধ্যান-ধারণা পর্যবেক্ষণ করেছেন। নিজের রাজনৈতিক দীক্ষা সকল ক্ষেত্রেই ইতিহাস। মানুষের মুক্তির সংগ্রাম যে কোনো ঘটনার বস্তুর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে।
লেখক হিসেবেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন। পার্টির তৎকালীন শীর্ষ নেতাদের সংস্পর্শে আসার মূল্যবান সময় তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন ‘আমার কিছু কথা’ শীর্ষক বইয়ে। তার ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে ‘ভ্রমণ কথামালা’ নামক গ্রন্থে।
বিশ্ব সমাজতন্ত্রের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে গঠিত বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও তিনি দীর্ঘদিন পালন করেছেন। বর্ষীয়ান এই কমরেড এর প্রতি রইল বিন¤্র শ্রদ্ধা। লাল সালাম।