প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীদের স্থান

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

প্রাচীন ভারতে নারীর স্থান নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ নানা সময়ে নারীর সামাজিক অবস্থান বিভিন্নভাবে বদলেছে। প্রাচীনকালে বিভিন্ন সময়ে রচিত প্রাচীন সাহিত্যে নারীর সামাজিক অবস্থানের চিত্র পাওয়া যায়। প্রাগৈতিহাসিক যুগে সমাজে মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে। কারণ হরপ্পা সভ্যতা ছিল মাতৃতান্ত্রিক। যেখানে নারীর স্থান ছিল উঁচুতে। বৈদিক যুগ থেকে পিতৃতন্ত্র দৃঢ় ভিত্তি লাভ করে। তবে এই যুগেও নারীর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কন্যাসন্তানের জন্ম অনভিপ্রেত হলেও তার যত্ন ও লালনপালনে কোনো ত্রুটি থাকত না। তার শিক্ষার দিকে যথেষ্ট নজর দেওয়া হত। ঘোষ, অপালা, বিশ্ববারা-র মতো নারীরা বৈদিক শ্লোক রচনা করেছিলেন। উপনিষদের যুগে গার্গী-র মতো দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেছিল। তিনি যাজ্ঞবল্ক্যের মতো পণ্ডিতের সঙ্গে বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন। উচ্চবর্ণের মহিলারা তাঁদের স্বামীর সঙ্গে যাগযজ্ঞে অংশ নিতেন। তাঁরা সম্পত্তির অধিকারিণীও ছিলেন এবং স্বামীর মৃত্যুর পর ইচ্ছা করলে পুনর্বিবাহ করতে পারতেন। ক্রমে সমাজে শূদ্র ও নারীদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। নারীকে বলা হত ‘ভার্ষা’; অর্থাৎ, ভরণীয়া বা যাকে ভরণ করতে হয়। তার স্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না। শিশুকালে সে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বয়সকালে বা বৈধব্য জীবনে পুত্রের অধীন। পুরুষদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রচলিত থাকলেও নারীদের মধ্যে তা ছিল না। স্ত্রীকে তার স্বামীর প্রতি অনুগত থাকতে হত। অথর্ব বেদে অবশ্য নারীদের বহুবিবাহের কথা উল্লেখ আছে। ঋকবৈদিক যুগে বিবাহ নারীর পক্ষে বাধ্যতামূলক না হলেও পরে তা হয়েছিল। এই সময়ে সতীদাহ প্রথা চালু ছিল না। বিধবা বিবাহ প্রচলন ছিল তা– সে দেওরের সঙ্গেই হোক, বা অন্য কারও সঙ্গে। অথর্ব বেদের যুগে সহমরণ বা সতীদাহের কথা জানা যায়। বিবাহে কন্যাপণের কথাও জানা যায়। ঋকবৈদিক যুগের গোড়ায় নারী গৃহে আবদ্ধ থাকত না; এমনকি মুদগলিনী, বিশপলা, শশিয়সী প্রভৃতি নারীর নাম পাই, তাঁরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরে ক্রমশ নারীর স্থান হয়েছিল অন্তঃপুরে। পুত্রসন্তানের জন্ম দেওয়াই ছিল তার প্রধান কাজ। নিঃসন্তান বা শুধু কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়া নারীকে পরিত্যাগ করার অধিকার তার স্বামীর ছিল। সেক্ষেত্রে স্বামী আবার বিবাহ করতে পারত। নারীর যৌন অপরাধের কোনো ক্ষমা ছিল না। কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে তা প্রশ্রয় পেত। নারীর মন বলে কিছু আছে, তা মনে করা হত না, এমনকি তাকে মারধোর করবার অধিকার তার স্বামীর ছিল। এক কথায় বলা যায়, প্রাচীন যুগে ‘নারীস্বাধীনতা’ ছিল বলে অনেকের যে ধারণা আছে, তা অনেকাংশে ভ্রান্ত বলে মনে করা হয়। নারী ছিল পুরোপুরি পুরুষের অধীন এবং তারই “সম্পত্তি”। বেদ পরবর্তী যুগে নারীর অবস্থার দিন দিন অবনতি ঘটেছে। বৌধায়নের ‘ধর্মশাস্ত্রে’, মনু প্রভৃতি স্মৃতিশাস্ত্রকারদের রচনা, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’, বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’, কালিদাসের বিভিন্ন নাটক, বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’ ও ‘হর্ষচরিত’, হর্ষবর্ধনের নাটক ‘রত্নাবলী’, মাঘের ‘শিশুপালবধ’, দন্ডির ‘দশকুমারচরিত’, শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’, কলহনের ‘রাজতরঙ্গিণী’ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে নারীর দুরাবস্থার কথা জানতে পারা যায়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর ভূমিকা ছিল শুধুমাত্র পুত্রের মাতা। তার কোনো স্বাধীনতা ছিল না। স্বয়ংবর ও গান্ধর্ব বিবাহ পদ্ধতি ক্রমশ অপ্রচলিত হয়ে পড়ে এবং আর্য ও আসুর বিবাহ প্রথা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিধবা বিবাহ ক্রমশ উঠে যেতে থাকে এবং জীবনের বাকি অংশ তারা শোক এবং কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে থাকে। তবে পর্দাপ্রথা ছিল না। নারীরা উৎসব এবং খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে পারত। হর্ষবর্ধনের সময় অর্থাৎ সপ্তম শতকে সতীদাহ প্রথার প্রচলন ছিল। শিক্ষাদীক্ষা উচ্চবর্ণের নারীদের মধ্যে সীমিত হয়ে যায়। তাদের বেদপাঠ নিষিদ্ধ হয়। সমাজে একমাত্র পতিতারাই শিক্ষিতা এবং স্বাধীন ছিল। তবে বৌদ্ধ ও জৈন পরিবারের মেয়েদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছিল। সাহিত্যে অবশ্য নারীকে প্রেমিকা রূপে দেখানো হয়েছিল। কলহন রক্ষণশীল ও নারী স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন। আবার এইযুগে লীলাবতী ও খনা-র মতো বিদূষী নারীরও সাক্ষাৎ মেলে। নারী স্বাধীনতা না থাকলেও তাদের যথেষ্ঠ সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা হত। স্বামীকে তার সাধ্যমতো স্ত্রীর ভরণপোষণ, বিলাসসামগ্রী, এবং অলংকারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হত। নারীদের তিরস্কার এবং মারধোর করা নিন্দনীয় ছিল। যে সব পুরুষ তাদের স্ত্রীদের মারধোর করে, ঈশ্বর তাদের পূজা গ্রহণ করেন না বলে শাস্ত্রের বিধান ছিল। মৌর্যযুগে ভারতীয় নারীর অবস্থা দুঃসহনীয় বা সম্পূর্ণ বিড়ম্বনার ছিল না। অর্থশাস্ত্রে বিধবা-বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। গুপ্তচর এবং অন্তঃপুররক্ষী হিসেবে নারীদের নিয়োগ করা হত। সমকালীন শাস্ত্রে নারীর ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকার করা হয়েছে। নারীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি ‘স্ত্রীধন’ হিসেবে অভিহিত হত। বিবাহকালে উপহার হিসেবে এবং পিতৃগৃহ থেকে উপহার হিসেবে নারী যা পেতেন সবই ‘স্ত্রীধন’ হিসেবে বিবেচিত হত। অর্থশাস্ত্রে বিবাহিতা নারীর অধীনে উচ্চ পরিমাণ অর্থ রাখার অধিকার দেওয়া হয়েছে। অবশ্য স্ত্রী ও স্ত্রীধনের ওপর স্বামী ও পুত্রের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব ছিল। স্বভাবতই মৌর্যযুগের নারীর পুরুষ-নির্ভন্নতা কঠোরভাবে মান্য হত। মৌর্যোত্তর ভারতে নারীর অবস্থান সম্পর্কে আমাদের প্রধান উপাদান হল মনুস্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি ও মহাভারত। তবে এদের বক্তব্যে স্ববিরোধিতা আছে। মনু বলেছেন যে, পিতার তুলনায় মাতা সহস্রগুণ সম্মানীয়। তাঁর মতে, যেখানে স্ত্রীজাতিকে শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানো হয়, সেখানে দেবতা সন্তুষ্ট হল। মহাভারতের মতে, স্ত্রী হল গৃহের গৌরব। শাসনকার্যে নারীর অংশগ্রহণের দৃষ্টান্তও পাওয়া যায়। জনৈকা রাষ্ট্রকূট রাজমহিষী শাসনকাজে অংশ নিতেন বলে জানা যায়। কিন্তু অন্যত্র মনু বলেছেন যে, নারী প্রথম জীবনে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। সাধারণভাবে বলা যায় যে, মৌর্যোত্তর যুগেও নারীর স্বাধিকার ও স্বাচ্ছন্দ্য পুরুষের ইচ্ছাধীন ছিল। গুপ্তযুগে নারীর অবস্থান প্রায় অপরিবর্তিত ছিল। কামসূত্রে বলা হয়েছে যে, অভিজাত বংশের কন্যাদের ‘চৌষট্টিকলা’ বা কাজে পারদর্শী হতে হত। সাহিত্য পাঠ, ইতিহাস জ্ঞান, ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে দক্ষতা, নৃত্য, গীত, গৃহকর্ম ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে নারীকে পারদর্শী হতে হত। অবশ্য সাধারণ পরিবারের নারীদের এহেন পারদর্শিতা অর্জনের সুযোগ ছিল না। এযুগেও স্বামীর সেবা, স্বামীর প্রতি আনুগত্য, পারিবারিক কাজকর্ম, সংসারের আয়-ব্যয়ের হিসাব রক্ষা ইত্যাদিকে নারীর আবশ্যিক কর্তব্য বলা হয়েছে। নারদস্মৃতি ও পরাশর স্মৃতিতে বিধবা-বিবাহের অনুমোদন দেওয়া হলেও, মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য তা অস্বীকার করেছেন। ‘স্ত্রীধন’ হস্তগত করার জন্য এই সময় সতীদাহ ব্যবস্থাকে উসাহিত করা হত বলে ড. রামশরণ শর্মা মনে করেন। গুপ্তযুগে পারিবারিক সম্পর্ক দ্বারা যুক্ত নয় এমন কিছু নারীর কথা কামসূত্রে বলা হয়েছে, যেমন– গণিকা, দেবদাসী ইত্যাদি। প্রাক-মুসলিম সমাজে নারীর অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। বরং রাজপুত সমাজে পর্দাপ্রথার প্রচলন জোরালো করার প্রবণতা দেখা যায়। সংগৃহীত

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..