রামমন্দির : মোদী, হিন্দুত্ব এবং রাষ্ট্র
অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধন আসলেই হিন্দুত্বের বিধান মেনে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়ে দেওয়ার এক প্রতীক। প্রভু রামের মূর্তিতে ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’য় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকার অর্থ– এটি পুরোদস্তুর একটি রাষ্ট্র-পোষিত অনুষ্ঠান। স্বাধীনতার পর এই প্রথম ভারত দেখছে ধর্ম, সরকার, রাজনীতি, মন্দির-পর্যটন, একটি স্থায়ী হিন্দু ধর্মীয় পরিকাঠামো নির্মাণ, পৌরাণিক সাহিত্য ও ধর্মীয় আচারের দুরন্ত সমন্বয়ে একটি আশ্চর্য সরকারি অনুষ্ঠান!
হিন্দুত্বকে রাষ্ট্রের আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করার লক্ষ্যেই অযোধ্যার এই অনুষ্ঠান। রামমন্দিরের উদ্বোধন এবং অযোধ্যায় তীর্থযাত্রীদের জড়ো করার মধ্যে রাষ্ট্র ও সঙ্ঘ পরিবারের তালমিল স্পষ্ট। এপ্রিল কিংবা মে মাসে লোকসভা নির্বাচন। সেই লক্ষ্যেই অযোধ্যার এই অনুষ্ঠান। ঘরে-ঘরে, মন্দিরে-মন্দিরে। প্রতিটি রাজ্য, প্রতিটি লোকসভা কেন্দ্র থেকে তীর্থযাত্রী ও সমর্থকদের নিয়ে আসা হবে অযোধ্যায়। এই কাজ চলবে মার্চ পর্যন্ত। অন্যদিকে, রামের নামে ভোট-সংযোগে বিজেপি। হিন্দু এলাকা তো বটেই। মুসলিম মহল্লা থেকে জনজাতি পল্লিতেও। সর্বত্র চলছে রাম-নাম। কিছুক্ষেত্রে সঙ্ঘ আর বিজেপি একসঙ্গে। কিছুক্ষেত্রে বিজেপি এককভাবে।
তবে রামমন্দির আর অযোধ্যা শহরের পুনর্গঠনের পুরো প্রকল্পে রয়েছে আরও সুদূরপ্রসারী ও গভীর লক্ষ্য। এটি হিন্দুত্ব আর রাষ্ট্রক্ষমতার মিলনের প্রতীক হয়ে থাকবে। রামমন্দিরের উদ্বোধনে তাঁর মুখ্য ভূমিকার মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ হবে প্রধানমন্ত্রী ও ‘রামরাজ্যে’র আদিপুরুষ হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তি নির্মাণের বৃত্ত। নিজেকে তিনি তুলে নিয়ে যেতে চাইছেন বিগ্রহের পর্যায়ে। মোদী এখন একইসঙ্গে ঈশ্বর এবং জনগণের বেছে নেওয়া একজন প্রতিনিধি। যিনি রাম, তিনিই প্রধানমন্ত্রী। সবার ঊর্ধ্বে। মোদী নিজেই বলেছেন, ‘ঈশ্বর আমাকে এই অনুষ্ঠানে ভারতের সমস্ত জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে বলেছেন।’ যেন ঈশ্বরের প্রেরিত দূত! হিন্দুত্বের ধাঁচে এটিই হলো তাঁর শাসন করার ঐশ্বরিক অধিকার!
রামমন্দির, জাতি, রাষ্ট্র সব একাকার। মোদী কেবল একটি সুরই বাজিয়ে চলেছেন, মন্দির হলো জাতীয় ঐক্য আর ভাবাবেগের প্রতীক। এবং এই দাবিই করে আসছে হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদ। অথচ, ভারতীয় সংবিধানের মুখবন্ধ অর্থাৎ প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ভারত একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র হিসেবে গড়ে উঠবে। ধর্মনিরপেক্ষ বলতে বোঝানো হয়েছে রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম থাকবে না। বা রাষ্ট্র কোনও ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে না। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-ই সর্বপ্রথম রামমন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে। কমিউনিস্ট পার্টির নীতি হলো ধর্মীয় বিশ্বাসে শ্রদ্ধা জানানো, প্রতিটি ব্যক্তির ধর্মচারণের অধিকারকে সুরক্ষা দেওয়া। ধর্ম হলো ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। একে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার হাতিয়ারে পরিণত করা উচিত নয়। পার্টির পলিটব্যুরো এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘অত্যন্ত খেদের বিষয় হলো বিজেপি এবং আরএসএস একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে রাষ্ট্র-পোষিত উদযাপনে পরিণত করতে চলেছে, যাতে প্রধানমন্ত্রী, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী-সহ অন্যান্য কর্তা-ব্যক্তিদের সরাসরি যুক্ত করা হচ্ছে।’ অথচ, ‘সুপ্রিম কোর্ট বারংবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ভারত সরকার চালানোর মৌলিক নীতি হল, সংবিধানের অধীনে থাকা ভারত রাষ্ট্রের কোনও ধর্মীয় স্বীকৃতি থাকা উচিত নয়।’ রামমন্দিরের উদ্বোধন সংগঠিত করতে গিয়ে এই নীতি লঙ্ঘন করেছে শাসকগোষ্ঠী। পার্টির সোজাসাপটা এই অবস্থান তাবৎ ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী শক্তির মনোভাবের ওপর প্রভাব ফেলেছে। বিরোধী কোনও বড় ধর্মনিরপেক্ষ দলের নেতাই অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন না। এই দলগুলির তরফে আমন্ত্রণ-প্রত্যাখ্যান অনুষ্ঠানটিকে পরিণত করেছে একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে।
বিজেপি-আরএসএস এবং তাদের বিশ্বস্ত কর্পোরেট মিডিয়া বিরোধীদে ‘হিন্দু-বিরোধী’ বলে দেগে দেওয়ার চেষ্টা করলেও তেমন লাভ হচ্ছে না। কারণ পুরী, জোশীমঠ, দ্বারকা এবং শৃঙ্গেরী– দেশের চার প্রান্তে চারটি মঠের প্রধান চার শঙ্করাচার্য অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন না বলে জানিয়েছেন। আর যাই হোক, শঙ্করাচার্যদের তো আর ‘আর্বান নকশাল’ বা ‘দেশদ্রোহী’র তকমা দেওয়া চলে না!
পুরীর শঙ্করাচার্যের সরাসরি অভিযোগ, রামমন্দিরকে উপলক্ষ করে ধর্ম নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আচরণ ‘উন্মাদের লক্ষণ’। গঙ্গাসাগরে এসে রামমন্দিরের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ‘দাদাগিরি’র যে অভিযোগ তুলেছেন তিনি। রাম যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত হওয়াতে অবশ্য তিনি খুশি। তাঁর কথায়, ‘এটা জরুরি ছিল।’ তবে ধর্মের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর এই ভূমিকাকে ‘বাড়াবাড়ি’ হিসেবেই দেখছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘প্রধানমন্ত্রীর নিজের সীমার মধ্যে থেকে কাজ করা উচিত। সংবিধান সম্মত বিধি-নিষেধ পালন করা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব। এই বিধিকে উপেক্ষা করে নিজের প্রচারের চেষ্টা করা উচিত নয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নিজের সীমার মধ্যে থাকা উচিত। ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা তাঁর উচিত নয়। সব ব্যাপারে দাদাগিরি করা এবং নেতৃত্ব দিতে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীর কাজ নয়! এমন কাজ করা উন্মাদের লক্ষণ!’
শঙ্করাচার্যদের এই আপত্তি-অসন্তোষের নেপথ্যে থাকতে পারে এক গভীর অর্থ। আরএসএস এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো তাদের সংগঠনগুলি হিন্দুধর্মকে কেন্দ্রীয় ধর্মীয় ব্যবস্থার এক নতুন ছাঁচে ঢালতে চাইছে, যাকে রোমিলা থাপার বলেছেন, ‘সিন্ডিকেটেড হিন্দুধর্ম’। যা হিন্দুধর্মের চরিত্রের বিরোধী, যা আসলে নানা বিশ্বাস, ধর্মীয় আচার-আচরণ এবং দেব-দেবীর এক বিশাল সমুদ্র। হিন্দুত্বের রাজনৈতিক প্রকল্প হিন্দুধর্মের এই বহুত্বের বিরোধী। নতুন হিন্দুত্ব রাষ্ট্রের এই ইমারত নির্মাণ করা হচ্ছে বৃহৎ ব্যবসার সম্পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতায়। অযোধ্যার অনুষ্ঠানে থাকছেন গৌতম আদানি থেকে মুকেশ আম্বানি। উদ্বোধন উপলক্ষে ছুটি ঘোষণা করেছে অম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ।
মন্দিরকে কেন্দ্র করে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির সুর চড়ানোর চেষ্টা চলবেই। তাকে প্রতিহত করতে হবে। ধর্ম এবং রাজনীতি দু’টি পৃথক সত্তা। যারা সেই সীমারেখাটি মুছে দিতে চায়, রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়ে দিতে চায়, তারা ধর্মকে শুধু ব্যবহার করে চলেছে নিজেদের রাজনীতির স্বার্থে। রামমন্দিরের উদ্বোধন সেকারণে আদ্যন্ত একটি রাজনৈতিক কার্যক্রম।
এই ভারত, নতুন ভারত নয়। কোনওভাবেই নয়।
-টিম মার্কসবাদী পথ
Login to comment..