চিরঞ্জীব কমরেড অ্যাডভোকেট এম এ কুদ্দুস

আবুল কাইয়ুম আহম্মদ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
জীবনে সত্যের সোপান ধরে যারা রেখে যান কর্মে ও মর্মে জাগ্রত জীবনের অনুধ্যান, সেবার মহান ব্রতে যারা হন আত্মনিবেদিত- তাদেরই একজন বিশিষ্ট আইনজীবী প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা, ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সভাপতি কমরেড অ্যাডভোকেট এম এ কুদ্দুস। তিনি ১৯৩৫ সালের ২৭ আগস্ট তৎকালীন নেত্রকোনা মহকুমার আটপাড়া থানার পাহাড়পুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মুন্সি ইসমাইল উদ্দিন। মাতার নাম ছাড়া বেগম। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। শৈশবে গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯৫০ সনে আঞ্জুমান হাই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন, পরে নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ১৯৬১ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনন্দমোহন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৬৫ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৬৫ সনে ২০ ডিসেম্বর বার কাউন্সিলের সদস্য হন। বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য্যের কিছুদিন সান্নিধ্য লাভের পর তিনি কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে ময়মনসিংহে চলে আসেন। ১৯৬৫ সালে ময়মনসিংহ জজ কোর্টে কিছুদিন আইন পেশায় জড়িত ছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে (হাইকোর্ট বিভাগ) সদস্য পদ নিয়ে আইন পেশা শুরু করেন। পরবর্তীকালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৭৩ সালে ময়মনসিংহ জেলা জজ কোর্টের সরকারি পি.পি হিসেবে কোলাবরেটার এসিটি মামলা পরিচালনা করে জয়ী হন। তিনি সুদীর্ঘ ৮৯ বছর সফলভাবে আইন পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। দুই চাচা রহম আলী আহম্মদের সান্নিধ্যে অ্যাডভোকেট এম এ কুদ্দুস গ্রামে থাকাবস্থায় মার্কসবাদ ও লেলিনবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ ভাবাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। যদিও তিনি রাজনৈতিক জীবনের মাঝামাঝি কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় সর্বভারতীয় যে কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে তিনি পিতৃব্য ও ছোট চাচার সাথে যোগদান করেছিলেন। এ সমাবেশের স্মৃতি তার পরবর্তীতে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন গড়ার পাথেয় হিসেবে কাজ করে। ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত থাকার কারণে তার পড়াশোনা বার বার ব্যাহত হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের ঢেউ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। নেত্রকোনায়ও সে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল। গঠিত হয়েছিল নেত্রকোনা মহকুমা ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম কমিটি। সে কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে মিছিলে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে অধ্যয়নকালে প্রগতি সংগঠন থেকে তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, তখন সরাসরি কোনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তাদের প্যানেল দেয়ার রেওয়াজ ছিল না। যেমন- প্রগতি, সংহতি ইত্যাদি নামে ছাত্র সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর এম এ কুদ্দুস ময়মনসিংহ ছাত্র ইউনিয়নকে সংগঠিত করে তুলেন। ১৯৬২ সালে সারাদেশে শুরু হয় আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন। তার সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দসহ আত্মগোপনকারী কেন্দ্রীয় নেতাদের যোগাযোগ ছিল। এমন পরিবেশে সেই আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যূত্থান এবং ৭০ এর নির্বাচনে জাতীয় নেতৃবৃন্দ যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেখানে অন্যদের মতো এম এ কুদ্দুসের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭০ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ পার্টির প্রার্থী হিসেবে নেত্রকোনা-আটপাড়া নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সনে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তখন তিনি ময়মনসিংহে স্থায়ী ছিলেন। মার্চের প্রথম দিকে ময়মনসিংহে বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবির নামে যে সংগঠন গড়ে উঠেছিল এম এ কুদ্দুস তাদের মধ্যে একজন। পরবর্তীকালে ২৫ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিজে, অধ্যাপক যতীন সরকার, ড. গোলাম সামদানী কোরায়শী, অধ্যক্ষ মতিউর রহমান তাদের নিয়ে ময়মনসিংহে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার-ছাত্র, তরুণ যুবকদের উদ্বুদ্ধ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার দৃঢ প্রত্যয় নিয়ে পরিবারসহ পিত্রালয়ের পাহাড়পুরে চলে আসেন। উল্লেখ্য, ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনায় আসার সময় সঙ্গে ছিলেন দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক যতীন সরকার। থানা হেড কোয়ার্টার আটপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তৎকালীন স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বৈঠক, সভা ও মিছিল করেন এবং স্থানীয় তরুণ-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। এক পর্যায়ে নিজ গ্রাম থেকে অনেক তরুণ-যুবককে সঙ্গে নিয়ে ভারতের মহেশখলায় চলে যান। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে তার পরিবারের সকলকে ভারতের মহেশখলায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখান থেকে তিনি ডালু মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যান এবং চান্দবইর ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা যুব ক্যাম্পের দায়িত্ব পান। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক হিসেবে চান্দবই রিফিউজি ক্যাম্প থেকে অনেক তরুণ যুবককে ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠান। বাঙালির সমন্বিত ত্যাগ ও তিতিক্ষার পর দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হল। এম এ কুদ্দুস তখন মেঘালয় থেকে চলে আসেন ময়মনসিংহে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে নেত্রকোনা-আটপাড়া নির্বাচনী এলাকা থেকে ন্যাপের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বাংলার জনমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বাকশাল গঠিত হলে তিনি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নেত্রকোনা জেলা বাকশালের অন্যতম সম্পাদক মনোনীত হন। নেত্রকোনার অন্যতম জনপ্রিয় নেতা আব্দুল খালেক এমপি নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে তিনি উপ-নির্বাচনে বাকশালের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। দেশীয় এবং আন্তজার্তিক অশুভ শক্তির ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সনে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হয়। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের নিয়ে এ হামলার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সংগঠিত আন্দোলনকালে তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৪ মাস কারাগারে থাকার পর হাইকোর্টে রিট পিটিশনের মাধ্যমে মুক্তি লাভ করেন। আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বাকশাল পুনরায় গঠিত হলে তিনি নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহে জেলা বাকশালের সভাপতি নির্বাচিত হন, তারপর কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তজার্তিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সামরিক শাসক জিয়ার ঘরোয়া রাজনীতির পর তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রগতিশীল রাজনীতির ধারার প্রার্থী ড. কামাল হোসেনের পক্ষে ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় নির্বাচন পরিচালনার সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের সময় ১৯৮৫ সনে ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মৃত্যুবার্ষিকী পালনকালে তিনি গ্রেফতার হন। এম এ কুদ্দুস ১৯৯১ সালে আটপাড়া-কেন্দুয়া নির্বাচনী এলাকায় বাম প্রগতিশীল জোটের বাকশাল মনোনীত প্রার্থী হিসেবে কাস্তে প্রতীক নিয়ে সংসদ নির্বাচন করেন। তিনি প্রগতিশীল ও বাম আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে ১০ বার গ্রেফতার হয়েছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি আইনজীবীদের সমস্যা ও দাবিদাওয়া নিয়ে সক্রিয় ছিলেন। গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে একজন সংগঠক হিসেবে যুক্ত থেকে কাজ করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। সামাজিক দায়বোধকে প্রাধান্য দিয়ে আইন পেশাকে জীবন চলার অবলম্বন হিসেবে বেছে নেন। আইনজীবী হিসেবে জীবনের শেষ ক্ষণ পর্যন্ত যারাই তার সংস্পর্শে এসেছেন তারাই তার সুবিশাল হৃদয়ের মানবতা ও উদারতার ছোঁয়া পেয়েছেন। এ কারণেই সেবাব্রতে নিবেদিত এই ব্যক্তিত্বের কাছে কোনো আইন পরামর্শ গ্রহণকারী বা তাদের আত্মীয় পরিজন সকলেই তাকে শ্রদ্ধা করেন। মানবতা ও মানবকল্যাণে বিশ্বাসী থেকে অনেক সময় নিজের অর্থে মামলা পরিচালনার দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন। ১৯৭১ সালে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং ৯০-এর গণঅভ্যূত্থানের আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল খুবই উজ্জ্বল। ১৯৯৭ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নিকট একটি খোলা চিঠি লিখেন। চিঠিতে নিজের আত্মসমালোচনাই প্রাধান্য পেয়েছিল। এ চিঠির মাধ্যমে তিনি পুনরায় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। মৃত্যুকালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির আইনজীবী সেলের সাথে যুক্ত ছিলেন। ২০১৫ সালের ৫ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতে মনোয়ারা হাসপাতালে স্ত্রী, তিন মেয়ে, তিন ছেলে এবং অগণিত গুণগ্রাহী ও স্বজনদের শোকে নিমজ্জিত করে এই মহান কমিউনিস্ট নেতার জীবনাবসান হয়। আত্মপ্রচারবিমুখ রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট এম এ কুদ্দুস নিজের স্বার্থের জন্য কাউকে কিছু বলা কখনো পছন্দ করতেন না। জীবনের শেষ দিনগুলো তার শরীর খুব একটা সায় দিচ্ছিল না। একটা না একটা শারীরিক জটিলতা লেগেই থাকতো। তবু কখনো পরমুখাপেক্ষী তিনি হননি। ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মার্কসবাদে বিশ্বাসী চিরঞ্জীব কমরেড অ্যাডভোকেট এম এ কুদ্দুস লাল সালাম।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..