এক.
কাওয়ালি শব্দটি আরবি ‘কওল’ থেকে এসেছে। কাওয়ালি সুফিদের গান। বহুকাল আগে সুফফ-সাধকগণ আধ্যাত্মিক প্রেমে মশগুল হয়ে বিশেষ কোনো নামের জিকির করতেন। অর্থাৎ, একই শব্দ বা বাক্য পুনরাবৃত্ত করতেন। সুরের মাধ্যমে এই পুনরাবৃত্তি ঘটলে তাকে কাওয়ালি বলা হতো। অষ্টম শতাব্দীতে পারস্যের বিভিন্ন সুফি আস্তানায় এধরনের গানের আসর বসতো। একে মাহফিল-ই-সামা নামেও বলা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, ৯০০ খ্রিস্টাব্দে সুফি মতবাদ ও দর্শন বিস্তৃৃতি লাভ করতে থাকে। দার্শনিক কথাবার্তার সমন্বয়ে রচিত হওয়া এসব গানের আয়োজন তৎকালীন সুফিবাদ চর্চার অন্যতম মাধ্যম ছিল। কবি আবু হামিদ আল গাজ্জালি (১০৫৮-১১১১ খ্রিস্টাব্দ) এসব গান রচনার জন্য পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত গজলের অন্যতম স্রষ্টা তিনি।
ভারতে সুফিবাদের মধ্যে চার ধরনের ধারা লক্ষ্যণীয়। এগুলো হল—চিশতীয়া, নিজামিয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া এবং নকশেবন্দীয়া। চারধারার মধ্যে চিশতীয়া ধারার অনুসারীগণের মাধ্যমেই বেশিরভাগ কাওয়ালির প্রচার এবং প্রসার লাভ করে। চিতশীয়া ধারার প্রবর্তক হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (রা.) নিজেও এই ধর্মীয় গানের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। হযরতের বিখ্যাত শিষ্য ছিলেন কুতুবুদ্দদিন বখতিয়ার কাকী (রহ.) এবং দিল্লির নিজামউদ্দিন আউলিয়া (র.) প্রমুখ। বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত আছে যে, কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকী (র.) সামা সংগীতে টানা কয়েকদিন মশগুল থাকতেন। এরপর নিজামুদ্দিন আউলিয়ার (র.) দরবারেও কাওয়ালির আসর বসতো। নিজামুদ্দীন আউলিয়ার (র.) প্রিয় শিষ্য হযরত আমির খসরু (র.) কাওয়ালি গানকে রীতিসিদ্ধ করেন। অর্থাৎ, কাওয়ালিকে একটি নিয়মের মধ্যে এনে প্রচার করেন তিনি। এজন্য তাকে কাওয়ালির জনক বলা হয়। সুফিবাদ চর্চার পাশাপাশি তিনি একাধারে কবি, গায়ক এবং একজন যোদ্ধাও ছিলেন। তার উপাধি ছিল ‘তুত-ই-হিন্দ’ বা হিন্দের তোতা পাখি।
কাওয়ালি গানে দাদরা, ধূমালি, রূপক, পশ্তু ইত্যাদি তাল ব্যবহৃত হয়। শিল্পীরা ‘কাওয়াল’ নামে পরিচিত। পুরান ঢাকার আদিবাসীদের মধ্যে এ গানের প্রচলন আছে। তারা ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে বিভিন্ন জলসা, বিবাহ ইত্যাদি অনুষ্ঠান উপলক্ষে এ গানের আয়োজন করে থাকে।
দুই.
মূলধারার ইসলাম—যার প্রতীক মসজিদ, তার সঙ্গে সুফি ধারার পার্থক্য আছে। মোদ্দা কথায়, সুফি পথে ভালবাসার মধ্যে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। সেখানে ঈশ্বরকে ভয় পাওয়ার কোনও জায়গা নেই। আর মূল ধারার ইসলামের পথ হল, ‘আল্লাহকে ভয় কর। তাঁর রাগের কারণ হয়ো না।’ মূলধারার ইসলাম অনেক বেশি প্রচলকেন্দ্রিক। সুফি ধারায় তা নয়। সেখানে নিজের মধ্যে ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা রয়েছে। তবে তার জন্য গুরু থাকা জরুরি। সুফি ধারায় নাচ-গানের গুরুত্ব অনেক বেশি। কোনিয়ায় সুফি গান ও সুফি নাচের ধারার শুরু করেছিলেন রুমি। তার মধ্যে যে মাদকতা আছে, তা হচ্ছে ঈশ্বরপ্রান্তির মাদকতা, যাকে ‘ফনা’ বলা হয়।
একদিকে ইতিহাস, অন্যদিকে মিথ আর কাওয়ালি সন্ধে। কাওয়ালির ইতিহাস সর্বজনবিদিত না হলেও এ বিষয়ে উৎসাহীরা ইতিমধ্যেই তা জ্ঞাত। হিন্দুস্তানী বা উত্তর ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ধারার সঙ্গে কাওয়ালির সম্পর্ক গভীর। এর মর্মবাণী বহুত্ববাদিতার এবং এতে ধর্মের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয় তা হচ্ছে মিস্টিসিজমের। যে কারণে এর আবেদন কেবল একটি ধর্মের মানুষের কাছে নয়।
তিন.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কাওয়ালি সংগীত অনুষ্ঠানে হামলা হয়েছে। হামলার অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে, যদিও ক্ষমতাসীন দলের এ ছাত্র সংগঠন স্বভাবসুলভভাবে অস্বীকার করেছে। হামলার কারণও স্পষ্ট নয়। কেন এই হামলা? কাওয়ালি ভারতীয় উপমহাদেশের একটি জনপ্রিয় সংগীত ধারা। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান―তিন দেশেই এ সংগীত প্রচলিত। কাওয়ালদের সঙ্গে উগ্রবাদীদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কাওয়ালরা সাম্প্রদায়িকও নন। তারা উদার ও সহজিয়া ধারার গায়ক। তাছাড়া এখানে মুর্শিদী-ভাণ্ডারি গানও হওয়ার কথা ছিল। মুর্শিদী-ভাণ্ডারি সংগীত উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে যায় না। দুটোর পরস্পর বিপরীত অবস্থান।
তবু এ হামলা কেন? কোন যুক্তিতে? কাওয়ালি উর্দুতে গীত হয় বলে? ভাষায় সমস্যা? ভাষায় তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। পৃথিবীর যে ভাষারই হোক, যা কিছু ললিতা, যা কিছু চিত্ররূপময়―সবই আমরা গ্রহণ করি। অতীতে করেছি, ভবিষ্যতেও করবো। একসময় বাংলাদেশের হাটে-মাঠে-ঘাটে সালমা আগার গান বাজতো, এখনো বাজে। সালমা উর্দু ভাষার গায়িকা। তাঁর কিংবা বাংলাদেশের শিল্পী রুনা লায়লা অথবা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আলমগীরের উর্দু গান শুনতে তো আমাদের কোনো সমস্যা হয় না। পাকিস্তানে এখন ভালো ভালো সিনেমা তৈরি হচ্ছে। আমরা সেসব সিনেমা দেখি। কই, আমার দেশপ্রেমের কোনো ঘাটতি তো দেখা দিচ্ছে না। এমনও হচ্ছে না যে, উর্দুর প্রেমে পড়ে আমি বাংলায় লেখা এবং পড়া ছেড়ে দিয়েছি। উর্দুতে যদি সমস্যা থাকে, তাহলে তো ‘আওয়ামী’ শব্দতে প্রশ্ন তোলাটা অযৌক্তিক হবে না।
১৯৫২ সালে আমাদের যে মহান ভাষা আন্দোলন, তা ছিলো পাকিস্তানের ভাষাগত রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিপক্ষে, সেটা উর্দুর বিপক্ষে নয়। তার নিষ্পত্তি সেইসময় হয়ে গেছে। ভাষা কোনো রাক্ষস নয়। তারপরও ভাষাবিদ্বেষের মতো ব্যাপার আমাদের মতো মূর্খের দেশেই সম্ভব। ভাষার কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক সীমানা থাকে না। সংগীতের কোনো দেশ নেই। সুরের কোনো দেশ থাকে না, বাউণ্ডারি থাকে না। মনে হচ্ছে না ভাষাগত সমস্যার কারণে এই হামলা হয়েছে। এই হামলার নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ আছে। সূক্ষ্ম কোনো কারণ। সেই কারণটি এখনো জানি না। অচিরেই জানতে পারবো নিশ্চয়ই।
ইসলামের সুফি ধারার সঙ্গে বিরোধ যদি কারণ হয় তবে হামলাকারী হবার কথা তাদের যারা এই ধারাকে অনৈসলামিক মনে করেন। এই ধরনের রাজনীতির ধারকরা যে কাওয়ালদের ওপরে হামলা করেন তা সকলের জানা। ২০১৬ সালে পাকিস্তানের করাচিতে বিশ্বখ্যাত কাওয়াল আমজাদ সাবরি’কে এরাই হত্যা করেছে। পাকিস্তান তালেবান এই হত্যার দায় নিয়েছিলো। তদন্তে এর সঙ্গে লস্কর-ই-ঝংভির সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এই সংগঠনের দুইজন সদস্যকে বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০১৮ সালে। তারা স্বীকার করেন যে তারা সাবরিকে হত্যা করেছেন। বাংলাদেশে এই ধারার সমর্থক আছে। কিন্তু তারা এই হামলা চালিয়েছে বলে এখন পর্যন্ত কেউ বলেন নি। এই বিবেচনায় এই হামলার পরে ইসলামের সঙ্গে কাওয়ালির সম্পর্কের আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক। এই ধরনের আলোচনা অ্যাকাডেমিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এখন আলোচনা করলে তাতে করে এই হামলার থেকে চোখ অন্যত্র সরে যেতে পারে।
যারা হামলা করে কাওয়ালি অনুষ্ঠান প- করেছে, তারা সম্ভবত কাওয়ালি সংগীতের ইতিহাস জানে না। তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদ বা ভাষা আন্দোলনের মর্ম কিছুই বোঝে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাওয়ালি সংগীত অনুষ্ঠান প- করার কাজটা ভীষণ অন্যায় হয়েছে। এটা কেবল সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ইঙ্গিত নয়, এর মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বৃহত্তম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ-আবহও ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
পুরানো একটা অশুভ চক্র নানাভাবে-নানা মাত্রায় জেঁকে উঠছে। নিশ্চয় আমাদের মনে আছে, কাদিয়ানি-আহমদিয়া কিংবা সুফিদের বিরুদ্ধে ‘ভিন্নমতকে খারিজ করা’ এই অশুভ চক্রটির বহুদিনের একটা আক্রোশ রয়েছে। এমনও কী হতে পারে, তাদেরই এজেণ্ডা ছিলো―টিএসসিতে কাওয়ালি সংগীত অনুষ্ঠানে হামলা করা, যা বাস্তবায়ন করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন।
চার.
কাওয়ালি অনুষ্ঠানে হামলার আর কারণ কী হতে পারে? যে কারণে ছাত্রলীগ কোটা সংস্কার আন্দোলনের ওপরে, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ওপরে, অন্যান্য ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের ওপরে হামলা করে, এই হামলা তা থেকে ভিন্ন কিছু না। এসময়ে কাওয়ালির অনুষ্ঠানকে নিছক গানের অনুষ্ঠান বলার সুযোগ নেই। ছাত্রলীগ তা মনেও করেনি। বরং সে বুঝতে পারছে তার পলিটিক্যাল প্রতিপক্ষ এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। যেটা সে হতে দিতে চায় না (ইতিমধ্যে ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসাইনের কথায় এটা পরিস্কার)। ছাত্র অধিকার পরিষদ বা এই জাতীয় প্রো মুসলিম সংঠনগুলোকে ছাত্রলীগ চান্স দেবে না―বুঝে হোক বা না বুঝে, এটা তার পলিটিক্স। ছাত্রলীগের এই পলিটক্সে ভুল আছে। সে হয়তো নিজের অজান্তে এমন একটা কাজ করে ফেলছে, যেটা ইন্ডিয়ায় আরএসএস করে। ক্ষমতাসীন দল যে পরিসীমা নির্ধারন করে দেবে তার বাইরের কিছুই সহ্য করা হবেনা। সামাজিক মাধ্যমে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে যেমন আইন করেই সীমা টেনে দেয়া হয়েছে―এটিও তাই। কাওয়ালির অনুষ্ঠানে ভিন্নমত কোথায় এই প্রশ্ন করতে পারেন। এখানে ভিন্ন মত হচ্ছে এটি ক্ষমতাসীনদের দেয়া সাংস্কৃতিক পরিসীমার বাইরে, তারা যা অনুমোদন দেয়নি এটা তার একটি। তারা মেরে মেরে নুরুকে জননেতা বানিয়েছে। এখন নুরুর রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিয়েছে।
এই হামলার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, আগে সমাবেশে হামলা হতো, মিছিলে হামলা হতো, এখন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলা হচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি কেবল প্রচলিত রাজনীতির মধ্যে সীমিত থাকে না। তা ক্রমাগতভাবে বিস্তার লাভ করে। রাজপথের রাজনীতি, গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যমের ওপরে নিয়ন্ত্রনের ধারাবাহিকতায় এখন সাংস্কৃতিক চর্চায় তা প্রসারিত হচ্ছে। মত প্রকাশের, কথা বলার, সমাবেশ করার স্বাধীনতা সীমিত হয়ে গেলে সাংস্কৃতিক চর্চার জায়গা অবারিত থাকবে এমন মনে করার কারণ নেই। এই হামলার ব্যাখ্যা এবং প্রতিবাদের জায়গাটা এইখানেই। কেবল টিএসসিতে নয়–সারাদেশে সব জায়গায় কাওয়ালি হবে, কীর্তন হবে, গণসংগীত হবে, ব্যান্ড সংগীত, রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত সবকিছু চলবে।