একতা প্রতিবেদক :
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য, ঢাকা জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি, অগ্নিযুগের বিপ্লবী কমরেড সুনীল রায়ের জন্মশতবার্ষিকী আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর।
১৯২১ সালের এই দিনে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার শ্যামগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা দেবেন্দ্র রায় এবং মা শষীবালা রায়। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সুনীলকে নবীনগরের এম কে মাধ্যমিক স্কুলে পড়া অবস্থায় চলে আসতে হয় নারায়ণগঞ্জে মাসির কাছে। ভেবেছিলেন পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু হল না। মামা ছিলেন নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে চিত্তরঞ্জন কটন মিলের বড় মাপের কর্মকর্তা। জড়িয়ে পড়লেন শ্রমিকদের জীবনের পথে। ইতোমধ্যে পরিবারের অভাব অনটন আরও শোচনীয় রূপ ধারণ করলো। বাধ্য হয়েই চাকুরি নিলেন চিত্তরঞ্জন কটন মিলে। শ্রমিকের চাকুরি।
ওই সময় এ অঞ্চলে শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে শ্রমিক আন্দোলন চলছিল। তিনি সেই আন্দোলনে যোগ দেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি কমরেড নলিনী ভট্টাচার্যের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪২ সালে লাভ করলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ। ১৯৪৪-৪৬ সালে ভারতজুড়ে যে শ্রমিক আন্দোলন প্রবলভাবে সংগঠিত হয়, সেই আন্দোলনে ঢাকা অঞ্চলে কমরেড নেপাল নাগ, কমরেড অনিল মুখার্জি, কমরেড মৃণাল চক্রবর্তী, কমরেড ননী চৌধুরী, কমরেড অমর গাঙ্গুলীর সঙ্গে কমরেড সুনীল রায়ও ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ-শ্যামপুর-পোস্তগোলা অঞ্চলে শ্রমিকদের সংগঠিত করেন। এই কাজ করতে গিয়ে ১৯৪৭ সালে তিনি চাকরিচ্যুত হন। তাতে দমে যাননি। শুরু হলো তিনি সহ অন্য শ্যমিকদের চাকরির দাবিতে লাগাতার আন্দোলন, ধর্মঘট শুধু এই মিলেই সীমাবদ্ধ থাকল না। আসে পাশের কারখানাগুলোতেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো। পুলিশের গুণ্ডা বাহিনী এমনকি সেনাবাহিনীকেও ডাকা হলো আন্দোলন থামানোর জন্য। ৮ জন শ্রমিক নিহত হলেন, শতাধিত আহত। নির্যাতন গ্রেফতার চলতে থাকে।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিত হয়ে মিল কর্তৃপক্ষ দমন নীতি বাড়িয়ে দিল। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলন দমন করা গেলো না। এক পর্যায়ে কমিউনিস্ট ও শ্রমিক নেতাদের আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করা হলো। আত্মগোপন অবস্থায় ১৯৫০ সালে দ্বিতীয় দফায় গ্রেফতার সুনীল মুক্তি পান ১৯৫৩ সালে। মুক্তির পর ঢাকার সূত্রাপুরের বাসায় নতুন করে আদমজী জুট মিলে চাকুরি নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত থাকলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের হয়ে কাজ করেন। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচিত হলো, কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির ভাগ্যের ন্যূনতম পরিবর্তন হল না। সাম্প্রদায়িক উস্কানি চললো। আবার আত্মগোপন পুলিশি হয়রানি এই অবস্থায় পুনরায় গ্রেফতার হলেন ১৯৬০ সুনীল। আবারও চার বছর। মুক্তি পেলেন ১৯৬৪ সালে। তখন শ্রমিক নেতাদের উপর নির্যাতন ক্রমশ বাড়তে থাকে। এর মধ্যেই আন্দোলন সংগ্রাম চলতে থাকে। সিদ্ধান্ত নারায়ণগঞ্জ থেকেই কাজ করবেন ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যূত্থানের পূর্বেই গ্রেফতারি পরোয়ানা, আবার আত্মগোপনে। এই অবস্থায় পার্টির সাথে যুক্ত থাকলেন সুনীল। নারায়ণগঞ্জের সুতাকল পাটকলগুলোতে শ্রমিক আন্দোলন রাজনৈতিক সামাজিক আন্দোলনের শুধু নেতাই ছিলেন না এক পর্যায়ে উনিই ছিলেন প্রধান নেতা।
স্বাধীনতা সংগ্রামে সুনীল রায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীর ক্যাম্পে ছিল তাঁর অন্যান্য সাধারণ ভূমিকা। ন্যাপ ছাত্র ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ গেরিলা বাহিনীর শত শত মুক্তিযোদ্ধা এই এলাকা থেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
সুনীল রায় নিজের জীবন থেকে সাম্যবাদের দীক্ষা নিয়েছিলেন। পড়ালেখা না করতে পেরে অল্প বয়সে শ্রমিকের কাজ করতে যেয়ে তিনি শ্রমিক শোষণ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। আর ওই সময়ের কমিউনিস্টদের আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত থেকে তিনি মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। তাই তো আমৃত্যু কমিউনিস্ট জীবনযাপন করেছেন। কমরেড সুনীল রায় শুধু স্বল্পভাষী ছিলেন না, ছিলেন মিত্যবায়ী, সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সততা-আদর্শ ও ত্যাগের এক মূর্তমান প্রতীক। শান্ত স্বভাবের হলেও তিনি আর্দশের প্রশ্নে অগ্নিরূপ ধারণ করতেন।
সোভিয়েত বিপর্যয়ের পর ১৯৯৩ সালে বিলোপবাদী-সংস্কারবাদীরা পার্টিকে চরম সংকটে ফেলে দেয়। ডাকসাইটে নেতারা যখন বিভ্রান্ত, তখন সুনীলদারা ইস্পাতদৃঢ়তায় লাল পতাকা উড্ডীন রেখে কমিউনিস্ট পার্টিকে আবার সংগঠিত করেছেন। তিনি পার্টির কাজ করতে যেয়ে বার বার গ্রেপ্তার হয়েছেন, আত্মগোপনে গিয়েছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু পার্টির কাজ, শ্রমিক-মেহনতি মানুষের সংগ্রাম থামিয়ে দেননি।
সুনীল রায় স্বাধীনতার পর সূত্রাপুরের রেবতি মোহন দাশ রোডে ন্যাপ নেতা মনিন্দ্র গোস্বামীর বাড়িতে থাকতেন। ঢাকা শহরে পার্টির যতগুলো গোপন আস্তানা ছিল এটি তার মধ্যে একটি। তিনি প্রতিদিন সূত্রাপুর থেকে পার্টি অফিস পল্টনে হেঁটে যেতেন ও আসতেন। পথে বিভিন্ন বাড়িতে যেতেন, কথা বলতেন। তার পকেটে থাকতো চকলেট, হাতে খেলনা। যে বাড়িতে গিয়েছেন, সেখানকার শিশু-কিশোরদের জন্য।
অকৃতদার সুনীল দা নিজের প্রতি খুবই উদাসীন ছিলেন, শেষ দিকে বিভিন্ন রোগে ভুগেছেন। অসুস্থতা যখন দীর্ঘস্থায়ী হলো, প্রিয় এলাকা নারায়ণগঞ্জে থাকতেন। ২০০১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ৮১ বছর বয়সে কমরেড সুনীল রায়ের জীবনাসান ঘটে।