ভ্রান্তিকালে লেখকদের কাছে প্রত্যাশা

জামসেদ আনোয়ার তপন

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
সত্য যেখানে থমকে দাঁড়ায়, এগুতে ভয় পায়, সাহিত্য এসে হাত ধরে নিয়ে যায় সামনে, বলে ‘এতটুকু পথ মাড়িয়ে এলে, বাকিটাও পারবে, এগিয়ে যাও’। সাহিত্য মানুষের মন থেকে ভ্রান্তি সরিয়ে দেয়। মস্তিষ্কে জমে থাকা ধুলোর আস্তরণের মত যাবতীয় অমানবিক ক্লেদ পরিষ্কার করে দিয়ে মনকে পবিত্র করার দায়িত্ব নেয় সাহিত্য। তবে যে সাহিত্য মানুষের সংগ্রামশীলতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, প্রতিপক্ষকে মদদ দেয় তা প্রকৃতপক্ষে কোনো সাহিত্যই নয়। প্রকৃত সাহিত্যিক ও শিল্পী শেষ বিচারে জনগণের পক্ষেই অবস্থান নেন। তথ্য-প্রযুক্তির অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা, বিশ্বায়নের নতুন ধরণ ও ধারা, পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের নিত্যনতুন সঙ্কট ও সঙ্কটমোচনে ফের নতুন সঙ্কটের উদ্ভাবন, পুরনো ঔপনিবেশিকতার কৌশল বদলে নব্য ও মনস্তাত্বিক উপনিবেশের সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়া গোটা বিশে^র মানুষকে এক ধরনের মোহগ্রস্ততার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যদিও বর্তমান শতাব্দির প্রথম দুই দশকেই এসব বুজরুকি বুঝতে পারছে পৃথিবীর মানুষ। গত শতাব্দির দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর মানুষ যে উপলব্ধির দরজায় দাঁড়িয়েছিল, ধারণা করি এ শতাব্দির প্রথম দুই দশকে পৃথিবীর মানুষ তার চেয়েও গভীর অভিজ্ঞানলব্দ উপলব্ধির কাছে দাঁড়িয়েছে। সাম্রাজ্যবাদীগোষ্ঠী পুঁজির স্বার্থকে নিরঙ্কুশ রাখতে তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যম দ্বারা ‘কমিউনিজমফোবিয়া’কে পরবর্তী সময়ে ‘ইসলামোফোবিয়া’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছে। ৯/১১ পরবর্তী ইসলামোফোবিয়া সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বিশ্বকে নতুন এক ‘ভ্রান্তিতে’ ফেলে দেয়া, সুনির্দিষ্টভাবে একটা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে বিশ্বকাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়া এবং সাম্রাজ্যবাদী পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে ওই ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে উগ্রবাদের বিস্তৃতি ঘটানোর গোটা প্রক্রিয়াটি বিশ্বকে একটা নতুন বাস্তবতায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমাদের বাংলাদেশে এর অভিঘাত পড়েছে ভয়ঙ্করভাবে। দেশের মধ্যেও সামাজিক মদদ পাচ্ছে ধর্মীয় উগ্রতা। তার ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রও হয়ে উঠছে ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক। শুধু সাম্প্রদায়িকই নয়, রাষ্ট্র হয়ে উঠছে শোষণের সবথেকে ঘৃণ্য বর্বর যন্ত্র। আজ এমন এক রাষ্ট্র আমরা প্রত্যক্ষ করছি যে নিজেই হয়ে উঠেছে চরম নৈরাজ্যবাদী। এখানে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা, চরম অন্যায়, অবিচার, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, ফ্যাসিবাদী প্রবণতা, অসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িকতার সামাজিকীকরণ ঘটে গেছে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে। সাংস্কৃতিক অবক্ষয় গোটা দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। . এসব অনাচারের বিরুদ্ধে আমরা সব সময় লেখক সমাজকে উচ্চকিত দেখেছি। একসময় লেখক শিল্পী সমাজের মধ্যে ছিল দারুণ ঐক্য, ছিল যূথবদ্ধ লড়াই। যা আজকের বাস্তবতায় অনেকটাই অনুপস্থিত। সামাজিক অস্থিরতা ও পরস্পর বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতিশক্তি। ফলে সময়টা ভীষণ কুহেলিকাপূর্ণ। মনে হতে পারে আমরা বিজয়ী। আসলে আমরা সেই পরাস্ত নাগরিক, যার কাঁধে একটা আহতÑক্ষত-বিক্ষত রাষ্ট্র, একটা দেশ অসাড় পড়ে আছে। ওর মুখ থেকে চুয়ে পড়ছে অন্ধকারের লালা। বুক থেকে অনবরত নিঃসরিত হচ্ছে বিপন্ন স্বপ্নের হাহাকার। এ দেশ আমরা চাইনি। আহত এ দেশকে কাঁধে করে চলবো এ কথা ঘূণাক্ষরেও ভাবিনি। এখানে চিন্তার স্বাধীনতা রহিত হয়ে আছে। কথা বলার অধিকার মুখ থুবড়ে পড়ে আছে কালা আইনের খড়গের নিচে। বিপরীত মত ভীষণ জব্দ, পান থেকে চুন খসলেই মৃত্যু এখানে পানির দর পেয়ে যায়। অধিকারের কথা বলতে গিয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা হয় শ্রমিকের বুক। গুম ঘরে জমা হয় অগুনতি লাশ। উন্নয়নের ভ্রুকুটির কাছে জড়োসড়ো গণতন্ত্র। সাম্প্রদায়িক উগ্রগোষ্ঠীর নসিহতে আমাদের দিন ও রাত নির্ধারিত হয়। রাষ্ট্রধর্মের বজ্জাতি গিলে খায় মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। অশালীন এ দূর্দৈব মানুষ আনেনি কখনো, এনেছে শাসকেরা। এ শাসনবলয়ের বিপরীতে মানুষকেই দাঁড়াতে হবে অস্তিত্বের প্রগাঢ় প্রয়োজনে। ভ্রান্তির আকাশে ঝকমারি রঙ দেখে বসন্ত বলে ভুল করা চলবে না। বসন্ত রুদ্ধ। বসন্ত আনতে হবে ছিনিয়ে। লড়াই ছাড়া কোনোদিন বসন্ত আসেনি; কৃষ্ণচূড়া রাঙেনি কোনো বৃক্ষে। শেকড়ে মাটি ছাড়া, পলি-কাদা-জলছাড়া বৃক্ষ কি প্রাণ পায়? স্বপ্নের কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষকে প্রাণ দিতে লড়াইয়ের বিকল্প কি আছে আর? মানুষের মুক্তি, সংস্কৃতির মুক্তি, অবরুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার মুক্তির জন্য লড়াই-ই শেষ ঠিকানা। তাই লড়াইটা ভুলে গেলে চলবে না। লড়াইয়ের প্রস্তুতি চলুক গানে-কবিতায়, নাটকে। চিত্র-চলচ্চিত্রের অভিধানে উৎকীর্ণ হোক নতুন অভিযান। মানুষের মিছিলে দাঁড়িয়েই উচ্চারিত হোক এ শুধু সত্য যে নব প্রাণে জেগেছে, রণসাজে সেজেছে, অধিকার অর্জনে। কোনো প্রকৃত শিল্পী বা লেখক তার সময়কে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। এই অতৃপ্তি বা অসন্তুষ্টিই শিল্পীর সৃজনশীলতাকে উস্কে দেয়। জন্ম হয় নতুন নতুন গান কবিতা নাটক গল্প সিনেমা ইত্যাদি। বর্তমান অসহনীয় অবস্থার বিরুদ্ধে নতুন শিল্পভাবনা ও পরিবেশনা নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হতে হবে। নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন ও সংগ্রামকে উস্কে দিতে হবে। এজন্য লেখক ও শিল্পীসমাজের সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে এক নতুন মিথষ্ক্রিয়া। লেখকদের ভাবনা আর সংস্কৃতিকর্মীদের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতার সমান্তরাল শক্তিকে পুঁজি করে নতুন সাংস্কৃতিক সংগ্রাম রচনা করতে হবে। যেহেতু লেখক, কবি, সাহিত্যিকরাও একেকজন আদর্শ সংস্কৃতিকর্মী, সেহেতু সামগ্রিক সাংস্কৃতিক সংগ্রামে তাদের অগ্রসর ও বিপ্লবী ভূমিকা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। নতুন বাস্তবতা দেশ ও মানুষ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। আসুন প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে দাঁড়াই। মানুষের জয়গান গাই। লেখক: সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, উদীচী

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..