শ্রমিকরা সরকার-রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয়ংকর থাবার মুখে
জলি তালুকদার
চলমান বৈশ্বিক মহামারী পরিস্থিতিতেই দেশের শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের বিরুদ্ধে একের পর এক আক্রমণ চলছেই। বস্তুত এই মহামারী পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়েই শোষণ জুলুম তীব্র থেকে তীব্রতর করা হচ্ছে।
শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এতো দুঃসময় বাংলাদেশের শ্রমিকরা হয়তো খুব কমই পার করেছে। এমনিতেই অনির্বাচিত সরকারের আমলে কিংবা অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র্র কাঠামোতে সবচেয়ে বেশি জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষ। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে আমরা দেখেছি জরুরি আইন কিংবা স্বৈরাচারী শাসন আমলে ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ওপর তীব্র আক্রমণ হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি খুব একটা ব্যতিক্রম নয়, উপরন্তু যুক্ত হয়েছে শ্রমিক আন্দোলনকে ক্রমেই বিপ্লবী ধারা থেকে বিপথে নিয়ে একটি শ্রেণি সমন্বয়ের সুবিধাবাদী পথে আটকে ফেলার উদ্যোগ। এই অবস্থায় এদেশের শ্রমিক শ্রেণি আজ সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয়ংকর থাবার মুখে পড়েছে।
শাসকশ্রেণি সাম্রাজ্যবাদ ও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তিসমূহের স্বার্থের অনুকূলে দেশ পরিচালনা করছে। তারা বিশ্বব্যাংকসহ লগ্নিপুঁজির প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্দেশ মেনে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলো প্রথমে পরিকল্পিতভাবে লোকসানি এবং পরে বন্ধ ও বিক্রি-বরাদ্দের মধ্য দিয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে। শাসকশ্রেণির যে অংশ মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতাসীন, তারা একদা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প রক্ষার লোক দেখানো ওয়াদা করলেও বিরাষ্ট্রীয়করণ, শিল্প ধ্বংসের কাজে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। একদিকে সরকারি শিল্প ও শ্রমিক স্বার্থবিরোধী নীতির ফলে শ্রমিক-চাষী-জনতা সীমাহীন জুলুমের শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে তাদেরই তল্পিবাহকরা শ্রমিক আন্দোলনকে লক্ষ্যহীন, শ্রেণি চেতনা পরিত্যাক্ত এক চোরাগলিতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
করোনা মহামারীতে শ্রমিকদের ভাতের যোগান নিশ্চিত করার বদলে সরকার একসাথে ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল ও ৬টি চিনিকল বন্ধ করে দিল। এসব শিল্পের জমি, সম্পত্তি লুট ও বেদখলের নীল নকশা বাস্তবায়ন হচ্ছে। পাটকল বন্ধের মধ্য দিয়ে প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিক, ১১ হাজার অস্থায়ী শ্রমিক, কয়েক লক্ষ পাটচাষী এবং চিনিকলের ৫ হাজার শ্রমিক, প্রায় ৬০ হাজার আখ চাষী একসাথে বেকার এবং চরম ক্ষতির মুখে পড়লো। করোনা মহামারীর এমন বিপর্যয়ের কালেও সরকার এমন চূড়ান্ত আক্রমণ চালাতে পিছপা হলো না।
এই মহামারীতে দেশের প্রধান রপ্তানিখাত পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ওপর সীমাহীন জুলুম নির্যাতন নেমে এসেছে। চার লক্ষাধিক শ্রমিক চাকুরিচ্যুতির শিকার হয়েছে। শুরুতে মালিকরা অর্ডার নাই, কাজ নাই বলে রব তুলে আর্থিক সুবিধা আদায় করার পরপরেই আবার লকডাউনের মধ্যে কারখানা খুলে দেয়ার তোড়জোড় শুরু করে। মালিকদের কথায় সরকার একদিকে গণপরিবহন বন্ধ রেখে অন্যদিকে কারখানা খোলার ঘোষণা দিয়ে শ্রমিকদের শত মাইল পায়ে হাঁটিয়ে শহরে এনেছে। আবার কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে কয়েক দিন পরেই আবার খুলে দেয়া হয়েছে। এভাবে শ্রমিকদের বারবার বিরাট হয়রানি ও স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছে।
সবাই যখন রাষ্ট্রীয় ঘোষণায় নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ছুটি পেয়েছে গার্মেন্ট শ্রমিকরা তখন কারখানায় কাজ করেছে। আবার এই শ্রমিকেরই ৩৫ভাগ বেতন কেটে নেয়া হয়েছে। তাদের ঈদের বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অথচ রাষ্ট্রীয় অর্থে প্রণোদনা, নানান নীতি সহায়তা ও রেয়াত এসব সুবিধা মালিকরা ঠিকই ভোগ করেছে। এই করোনার গোটা সময়ে দেশের মানুষ যখন লকডাউনে গৃহবন্দী তখন গার্মেন্ট শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি, ছাঁটাই, লে-অফের বিরুদ্ধে রাজপথে দিনের পর দিন আন্দোলন করতে হয়েছে। আন্দোলনের চাপে গণহারে লে-অফ করা ও ঈদের পূর্বে ছাঁটাই বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল সরকার ও মালিকপক্ষ। করোনাকালীন সময়ে ধারাবাহিকভাবে এবং দীর্ঘ সময় ধরে কারখানায় ও রাজপথে শ্রমিকদের এত বেশি সংখ্যক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে যার নজির পোশাক শিল্পের ইতিহাসে পাওয়া যাবে না।
এই সময়কালে বিশেষ করে পরিবহন, ট্যানারী, চা বাগানসহ বিভিন্ন খাতের শ্রমিক এবং হকারসহ শ্রমজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে মাসের পর মাস যে দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সাধ্যের অতীত। অথচ তাদের জন্য সত্যই তেমন কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ছিলো না। এই মহামারীতে শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের প্রতি সরকার ও মালিক শ্রেণি যে দায়িত্বজ্ঞানহীন, কাণ্ডজ্ঞানহীন ও নিষ্ঠুর আচরণ করেছে তাদের ভূমিকা ইতিহাসে এযুগের বর্বরতম জুলুম নির্যাতন হিসেবে দেখা হবে।
রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয়ে দেশে করোনা রোগের টিকা এসেছে, অথচ এই টিকা শ্রমিকরা পাচ্ছে না। যে পদ্ধতিতে টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে তাতে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। যাদের শ্রমে ঘামে সকলের অন্ন জোটে, যাদের উদয়-অস্ত শ্রমে ঘামে এত বিশাল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বাহাদুরি। চিকিৎসা, টিকা এবং স্বাস্থ্যসেবায় তাদের কোনো অগ্রাধিকার নেই। এটাই শাসকদের গৃহীত নীতি।
এর মধ্যেই শ্রম আইন ও বিধিমালা সংশোধনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মূলত বিশ্ব শ্রম সংস্থা (আইএলও)’র চাপে ২০১৮ সালে শ্রম আইন সংশোধন হয়। সেবার শ্রমিকদের অবাধে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলা হলেও বাস্তবে মালিকদের ইশারার বাইরে তেমন কিছুই হয়নি। বলতে গেলে শ্রমিক পক্ষের কোনো সংশোধন প্রস্তাবই গৃহীত হয়নি। এবার মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহে রপ্তানির ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা বহাল রাখার জন্যই শ্রম আইনের শ্রমিক স্বার্থবিরোধী কিছু ধারার অপরিহার্য সংশোধনের জন্য এই উদ্যোগ। কিন্তু সরকার এবং মালিকদের কৌশলটি স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। আইন সংশোধন করার এসব কাজকর্ম অর্থাৎ কমিটি মিটিং আর পেপার ওয়ার্ক দীর্ঘায়িত করে এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে চুক্তি নবায়ন করে নেয়া এবং তারপরে আর আসল কাজ কিছু না করা। এই পরিস্থিতিতে শ্রম আইনের শ্রমিকবিরোধী সব ধারা সংশোধনের জন্য রাজপথের আন্দোলন তীব্র করা একটি আশু কর্তব্য।
পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণির দাসত্বের এই বর্বর নতুন রূপকে দাস ব্যবস্থার মতো অতটা সাদামাটাভাবে বোঝা যায় না। কর্পোরেট পুঁজি ও নিও লিবারেল অর্থনীতির এই যুগে শ্রমিক শ্রেণির মজুরি দাসত্বের রূপটি একটু জটিল। আপাত স্বাধীন মনে হলেও শ্রমিক শ্রেণি কিভাবে মজুরি দাসত্বের শিকলে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা তা সহজে সবার কাছে বোধগম্য হয় না। বিশ্বব্যাপী পুঁজি ও পণ্যের অবাধ যাতায়াতের ফলে উন্নত বিশ্বে বসেই কর্পোরেট পুঁজি অনুন্নত দেশের শ্রমিকের উপর তীব্র শোষণ চালাচ্ছে, শ্রমিকের সর্বস্ব নিংড়ে নিচ্ছে। একদিকে বেসরকারিকরণের ধুম, অন্যদিকে অনুন্নত বিশ্বের শ্রমিকদের শ্রম যত সস্তায় কিনে নেয়া যায় সেই যোগান নিশ্চিত রাখার যাবতীয় পাঁয়তারা চলছে। এক্ষেত্রে নীতি হলো, যত বেশি নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া চালানো যায় শ্রমিকের শ্রম তত সস্তা হয়। আমাদের পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের শ্রম পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তায় কিনে নিচ্ছে আন্তর্জাতিক রিটেইলার ও ব্র্যান্ডগুলো। দেশীয় মালিকরা নিজেদের লভ্যাংশ ঠিক রাখার জন্য শ্রমিকের ওপর শোষণের মাত্রা দিনদিন আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই বিদেশি কিংবা দেশি মালিকরা শ্রমিকের জন্য বাজার দরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মজুরি, নিরাপত্তা, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং তাদের জীবন মানের উন্নয়নের বিষয়ে কখনোই গুরুত্বের সাথে কিছু ভাবে না। অন্য দিকে সরকার জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের জিগীর তুলে বাস্তবে ঐ দেশীয় মালিক শ্রেণি ও বহুজাতিক কর্পোরেট পুঁজির লুটপাট ও শোষণের ক্ষেত্র অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাহারা দিয়ে যাচ্ছ।
এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও পাটকল, চিনিকল ও পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের লড়াই অব্যাহত রয়েছে। জেল, জুলুম, হুলিয়া রাষ্ট্রীয় সকল বাহিনীকে সাহসের সাথে মোকাবেলা করছে। দীর্ঘদিন ধরে গৎবাধা কাজ ও বুলিতে অভ্যস্ত, বুর্জোয়াদের প্রভাবিত ট্রেড ইউনিয়ন পাট ও চিনিকলের শ্রমিকদের লড়াকু মেজাজ ও আন্দোলন ধরতে একবারে ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্রায়াত্ত্ব শিল্পগুলোতে ট্রাডিশনাল ও গৎবাধা ছকের বাইরে গিয়ে র্যাডিক্যাল ধারার আন্দোলন নতুন দিনের ঈঙ্গিত বহন করে। সর্বোপরি এই মহামারীতে যখন মানুষ দিশেহারা তখন সংগ্রাম করে কিভাবে বাঁচতে হয় তার অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে এদেশের শ্রমিকরা।
প্রথম পাতা
অভিবাসন খাতে দুষ্টচক্রের থাবা
ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন বোনাসসহ পর্যাপ্ত ছুটি দিতে হবে
প্রায় ৫৬ শতাংশের বেশি কোম্পানি কর দেন না
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে রুখে দিয়ে ফিলিস্তিনিদের মুক্তির লড়াইকে এগিয়ে নিতে হবে
মালয়েশিয়ায় যারা সেকেন্ড হোম করে আছেন তারা বৈধভাবে অর্থ নেননি : বাংলাদেশ ব্যাংক
বর্ষবরণে ১৩ নির্দেশনা ও সময় বেঁধে দিল সরকার
ঈদযাত্রায় ভোগান্তির শেষ নেই ঘরমুখো মানুষের
বেতন-ভাতা ও বোনাসের দাবিতে জি-স্কপের সমাবেশ
মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা চর্চার মধ্য দিয়ে গোলাম আরিফ টিপুকে স্মরণ করা হবে
নোটিশ
Login to comment..