ভাষা আন্দোলন ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণা

আকমল হেসেন

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
ভাষা ভাব প্রকাশের মাধ্যম। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষে মানুষে নানা প্রয়োজনে ভাবের আদান-প্রদানের জন্য ভাষা অন্যতম উপায়। অবিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা মহামতি ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন সমস্যা সমাধানে প্রথমে সমস্যাকেই সঠিকভাবে সনাক্ত করার তাগিদ দিয়েছিলেন, কারণ সমস্যা সঠিকভাবে নির্ধারণের উপরই সঠিক সমাধান নির্ভর করে। একটি জাতির উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য, ভাষা ও সংস্কৃতিগত ভিত্তি গুরুত্বপূর্ণ। শোষক ও শাসকেরা এ বিষয়টি আরও ভাল করে বোঝে। তাইতো পাকিস্তানী শাসকেরা তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে শুরুতেই ভাষার ওপর আঘাত হেনেছিল। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হলেও দু’দেশের দুই কর্ণধার জওহরলাল নেহেরু ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দুজনই ব্যক্তিজীবনে আধুনিক মনের হওয়ায় রাষ্ট্রকে ইহজাগতিক (সেকুল্যার) করার চেষ্টা করেছিলেন। নেহেরু সেটা করতে সক্ষম হলেও জিন্নার মৃত্যুর কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট পাকিস্থানের গণপরিষদের সভাপতির ভাষণে পাকিস্থান রাষ্ট্রের চরিত্র সম্পর্কে জিন্নাহ বলেছিলেন- “আপনারা স্বাধীন পাকিস্থান রাষ্ট্রে স্বাধীনভাবে আপনাদের মন্দিরে বা মসজিদে বা অন্য যে কোনও উপাশনালয়ে যেতে পারেন। আপনারা যে কোনও ধর্ম, গোত্র বা মতাদর্শের অনুসারী হতে পারেন। রাষ্ট্রীয় কার্যাবলির সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা এই মৌলিক নীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করছি যে, আমরা সকলেই এক রাষ্ট্রের নাগরিক, সবাই সমান নাগরিক। (১) জিন্নাহর প্রচেষ্টা ছিল আঞ্চলিক জাতিসত্তা বিলুপ্ত করে শক্তিশালী কেন্দ্র গড়া। যে কারণে একজন আধুনিক শিক্ষিত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও মিঃ জিন্নাহ বাঙালি জাতির ভাষা সত্তাকে বিলুপ্তির কথা বলেন। (২) অথচ এই মানুষটিই ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকে পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেন। যদিও পাকিস্থানের বাংলা ভাষাভাষির সংখ্যা ছিল তখন শতকরা ৫৬ আর উর্দু ভাষাভাষির সংখ্যা ছিল শতকরা ৭ ভাগ। “১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ করাচিতে পাকিস্থান গণপরিষদের গৃহীত রাষ্ট্রের আদশ প্রস্তাবে দেখা যায় মাওলানা-মোল্লাদের সুস্পষ্ট প্রভাব। এই প্রস্তাবে বলা হয় পাকিস্থান এমন একটি রাষ্ট্র হবে যেখানে পবিত্র কোরআন ও সুন্নায় বর্ণিত ইসলামের শিক্ষা ও অনুশাসনের ভিত্তিতে মুসলমানদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন গড়ে তুলতে সহায়তা করা হবে।” (৩) গণপরিষদের এই সিদ্ধান্তই পরবর্তীতে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে সহায়তা করে। বাংলাকে ‘হিন্দুয়ানী ভাষা’ বলে ফতোয়া আসে ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনীতিকদের পক্ষ থেকে। তবে এর আগে তথাকথিত বনেদি হিন্দু সংস্কৃতিসেবীদের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে ‘পাখির ভাষা’র উপাধি শুনতে হয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে মুসলিম লীগ ছিল উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের স্বার্থ সংরক্ষণকারী এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির সমর্থক দল। তাই তার শ্রেণি চরিত্র হিসেবে অর্থনৈতিক শোষণের প্রক্রিয়াকে সহজতর করতে ভাষার ওপর প্রথম হামলাটা করেছিল। তবে সেই হামলা বাঙালিকে দুর্বল করতে পারেনি। ১৯৫২ সালে রফিক, শফিক, বরকত ও জব্বারের জীবন দিয়ে হলেও বাংলা মায়ের দামাল সন্তান ছাত্র ও রাজনীতিকরা পাকিস্থানীদের সেই ষড়যন্ত্রকে রুখে দিয়েছিল। ১৯৫৬ সালের পাকিস্থানের শাসনতন্ত্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা স্বীকার করে নিতেই হয়েছিল, যদিও বাস্তবে তার প্রতিফলন তেমনটা দেখা যায়নি। ভাষার ওপর হামলার প্রতিবাদের কারণে ১৯৫৪ সালের প্রথম নির্বাচনেই বাঙালিরা যুক্তফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে মুসলীম লীগ সরকারের ভরাডুবি ঘটিয়েছিল। এখানেও তারা গণতন্ত্রের ওপর নগ্ন হামলা করে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ভেঙে কেন্দ্রের শাসন জারি করেছিল। যদিও শেষরক্ষা হয়নি। ’৫৮ এর সামরিক শাসন, ’৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ এর স্বায়ত্তশাসনমূলক শেখ মুজিবের ৬ দফা, ১৯৬৯ এর ছাত্র সংগ্রামের ১১ দফার আলোকে সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থান মুসলীম লীগ সরকারই শুধু নয়, পাকিস্থানী সামরিক সরকারের গদিও টলিয়ে দিয়েছিল। রাজনীতির ঐ জোয়ারে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্থানীদের আরও একবার ভরাডুবি ঘটেছিল। ১৯৫২ সালের ভাষার সংগ্রাম পরবর্তীতে বাঙালির জীবন-জীবিকার সাথে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল। শোষণ নির্যাতন আর বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে বিদ্রোহ করা মানুষ অনেক পূর্ব থেকেই শিখেছিল। হাতি খেদা আন্দোলন, টংক আন্দোলন, নানকার বিদ্রোহ, রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ডের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মুক্তি সংগ্রামের চেতনার বীজ ৫২ এর ভাষার সংগ্রামে রোপিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৮ এর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ৬৯ এর ঐতিহাসিক ছাত্র গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের বিজয় সর্বোপরি ১৯৭১ সালে বাংলার স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ধারণে অনুপ্রাণিত করেছিল। ভাষার সংগ্রাম ও রাজনৈতিক দলের ঐক্য : রাজনৈতিক কর্মীদের ঐক্য এবং সমন্বয় আর পেশাজীবীদের আন্দোলন, এক সুতায় গ্রথিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলন। ভাষার সংগ্রাম প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে পলাশী ও নীলক্ষেতের ব্যারাকের সাধারণ সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীদের দ্বারা। পাকিস্থানের শুরুতেই সরকার কর্তৃক নতুন মুদ্রা, মানি অর্ডার ফর্ম, খাম নোট কার্ডে বাংলার প্রচলন কমতে শুরু হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পক্ষ থেকে মিছিল হয় ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। ছাত্র জনতার এক মিছিল সচিবালয়ে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী মফিজউদ্দিনের নিকট বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়। শিক্ষামন্ত্রী ঐ দাবিতে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য হন। শিক্ষামন্ত্রীর স্বাক্ষর করার জন্য ব্যবহৃত কলমটি ছিল ভাষাসৈনিক ভাষা মতিনের। (৪) ১৯৪৭ এর আগে বাংলায় প্রধান রাজনৈতিক দল ছিল দুটি। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস। কংগ্রেস তুলনামূলকভাবে কম জনসমর্থনের হলেও বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ছিল সক্রিয়। নিষিদ্ধ অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টি আন্দোলনকে সঠিক ধারায় প্রবাহিত করার কাজটি করেছিল। ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ পাকিস্থান কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হলেও ১৯৪৭ সালে পার্টির পূর্ব পাকিস্থান আঞ্চলিক কমিটি গঠিত হয়েছিল। খোকা রায় সম্পাদক, মণি সিংহ, নেপাল নাগ, ফণী গুহ, শেখ রওশন আলী, মুনীর চৌধুরী ও চিত্তরঞ্জন দাস সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের কারণে নির্যাতিত হওয়া ছাত্ররা আব্দুল মতিনকে আহ্বায়ক করে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করতো। (৫)১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরিতে ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদের সদস্যদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল হাশেম, আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দিন আহম্মেদ, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন, শামসুল হক, আবুল কাশেম, আব্দুল গফুর, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহমেদ, মীর্জা গোলাম হাফিজ, আব্দুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক চৌধুরী, খালেক নেওয়াজ খান, সৈয়দ আব্দুর রহিম, প্রমুখ। (৬) ভাষা আন্দোলনে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালি পাকিস্থান স্বৈরশাসক, পঁজিবাদী ও সাম্প্রদায়িক সরকারের বিরুদ্ধে বাঙালির অধিকারের সংগ্রামকে সামনে এগিয়ে নিতে সাহস সঞ্চয় করেছিল। সেই সাহসকে বঙ্গবন্ধু কজে লাগিয়ে মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছিলেন। দেশপ্রেমের সাথে আত্মপরিচয়ের বিষয়টিও জড়িত থাকে। ইতিহাসকে বাদ দিলে বর্তমান পরিচয় অসম্পূর্ণ থাকে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ভাষার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজরা ইংরেজি ভাষা বিস্তারে আয়ারল্যান্ডে আইরিশ ভাষা বিলুপ্তির জন্য তৎপরতা চালিয়েছিল, কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে সফল হয়নি। উনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝিতে আয়ারল্যান্ডে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে বাঁচার তাগিদে দলে দলে আইরিশরা আমেরিকাতে পারি জমাতে থাকে এবং ইংরেজি বুলিও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। অভাবের দুর্বলতার সুযোগে মার্কিন ইংরেজরা আইরিশদের নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। শিক্ষত দেশপ্রেমিক আইরিশরা তখন আতংকের সাথে দেখলেন তাদের ভাষা সত্যি সত্যিই বিপন্ন, শুধু ভাষা নয় ভাষার সাথে সাথে সংস্কৃতিও। পরে আইরিশরা সচেতন ও প্রতিবাদী হয়েছিলেন, সফলও হয়েছিলেন। আইরিশ ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা পেয়েছিল। বাঙলিদের ১৯৫২ সালের ভাষার আন্দোলনও ঠিক তাই। তবে এখনও সর্বত্র বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত হয়নি। সর্বত্র বাংলা ব্যবহারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও খোদ সেই আদালতেই যেমন হয়নি তেমনই অফিস উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে এবং সাইনবোর্ড রেখার ক্ষেত্রেও সেটি করা যায়নি। প্রতি বছর বিভিন্ন মিডিয়া ও কিছু সংখ্যক সাংস্কৃতিক সংগঠন, ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠন সর্বত্র বাংলার ব্যবহার নিশ্চিতকরণের দাবিতে সোচ্চার হলেও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নীরবতায় ‘বাংলা’র দুর্দিন আর কাটে না। লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাকবিশিস, কেন্দ্রীয় কমিটি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..