মাতৃভাষা, মনুষ্যত্ব ও স্বাধীনতা

যতীন সরকার

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
“তারই নাম কবি, যিনি আবেগের দৈহিক অভিঘাত থেকে যাত্রা করে সেই দৈহিক অভিঘাত থেকে মুক্তি দেন মানুষকে, ইন্দ্রিয়গত সংবেদনকে রূপান্তরিত করেন সেই আধ্যাত্মিক সামগ্রীতে, যাকে আমরা অভিজ্ঞতা বলে থাকি। আমাদের এই আদিকবি একাধারে কাব্য, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের জনক। তাঁর চিত্তে আবেগ থেকে জ্ঞান নিষ্কাশিত হয়ে জ্ঞান আবার সঞ্জীবিত হয়েছে আবেগে; বিশ্বপুরাণ থেকে মানবেতিহাস বিশ্লিষ্ট হবার পর ইতিহাস আবার পুরাণের স্রোতে মিশ্রিত হয়ে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে। এবং তাঁর এ ভাষার জন্ম একই লগ্নে; তার সত্তা একান্তভাবে ভাষানির্ভর। মানুষের ভাষা আছে, এতেই প্রমাণ হয় যে তার সারাৎসার কবির। মানুষ যদি কবি না হতো তাহলে তার ভাষার প্রয়োজন হতো না।” কথাগুলো কবি বুদ্ধদেব বসুর। এগুলো যে প্রবন্ধ থেকে এখানে উৎকলিত, সে প্রবন্ধটির নাম– ‘ভাষা, কবিতা ও মনুষ্যত্ব’। ১৯৫৭ সালে বুদ্ধদেব বসু ঐ প্রবন্ধটি রচনা করেছিলেন যে প্রসঙ্গ অবলম্বন করে, সে প্রসঙ্গ আমার আলোচ্য নয়। এমন কি, সে প্রসঙ্গটি এখানে উল্লেখেরও প্রয়োজনবোধ করি না। আমি শুধু এই উৎকলিত অংশটুকুতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে চাই। এবং এই কথাগুলো আমার মনের পরতে পরতে যে সব ভাবনার সঞ্চার ঘটিয়েছে, সে সব ভাবনারই উৎসারণ ঘটাতে চাই। তবে বুদ্ধদেবের প্রবন্ধের শীর্ষনামটি চিত্তপটে সুগ্রথিত রেখেই আমাকে সে কাজটি করতে হবে। মানুষের মনুষ্যত্বের প্রকাশ, প্রসার ও বিস্তার ঘটে ভাষারই মাধ্যমে। ভাষাবিহীন মনুষ্যত্ব অকল্পনীয়। পশুত্বের সঙ্গে মনুষ্যত্বের পার্থক্য তো ভাষার মধ্যেই সৃষ্ট ও দৃষ্ট। ভাষাকে ধারণ করে যে মনুষ্যত্বের স্ফূর্তি ঘটেছে ও প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে, সেই ভাষাকে অবলম্বন করেই ‘যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান’। এই অর্থে কেবল ‘কেউ কেউ’ নয়, ‘সকলেই কবি’। এবং মেনেই নিতে হবে যে : প্রতিটি মানুষেরই ‘সারাৎসার কবির। মানুষ যদি কবি না হতো তাহলে তার ভাষার প্রয়োজন হতো না’। এ বিষয়টি বুঝে নিতে পারলে সকলের কাছে এ কথাও স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে: ‘আদিকবি’ সেই মানুষই ‘একাধারে কাব্য, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের জনক’। অর্থাৎ ভাষা দিয়ে সৃষ্ট মানুষের সকল কৃতিরই অভিন্ন পরিচয় ‘কবিতা’। এক সময়ে অবশ্যি ‘কবিতা’ বা কাব্য বলে চিহ্নিত করা হয়েছে বিশেষ ধরনের মানবিক সৃষ্টিকে, ‘যা মানবের জীর্ণ বাক্যে’ এমন ‘নবসুর’-এর সঞ্চার ঘটিয়েছে, যা ভাষাকে অর্থের বন্ধন হতে ছিন্ন করে নিয়ে গেছে কিছুদূর ‘ভাবের স্বাধীনলোকে’। তবে ভাবের স্বাধীনলোকে যতদূরই নিয়ে যাক না কেন, কবিতা সৃষ্টি হয় ভাষা দিয়েই এবং থাকতে হয় ভাষার আশ্রয়েই। অর্থাৎ অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে মানুষের সকল কৃতিই ভাষাশ্রয়ী এবং ভাষাশ্রয়ী কৃতিরই অপর নাম মনুষ্যত্ব। ভাষা আর মনুষ্যত্বকে অভিন্ন, অবিচ্ছিন্ন ও একার্থক বললেও বোধহয় ভুল হয় না। কিন্তু প্রশ্ন– সেটি কোন ভাষা? উত্তর– মাতৃভাষা। এই মাতৃভাষাকে যে মায়ের ভাষাই হতে হবে, তা নয়। আমরা প্রায় সবাই মায়ের মুখ থেকে শুনেশুনেই ভাষা শিখে থাকি বলে মাতৃভাষা আর মায়ের ভাষাকে একার্থক মনে করি। এ রকম করাকে পুরোপুরি ভুল যদি না-ও বলি, কিছুটা ভুল যে এতে আছে- সে কথা মানতেই হবে। সে ভুলের সংশোধন করা দরকার অবশ্যই। কোনো মানবশিশুকে যদি জন্মের পরই তার গর্ভধারিণী মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে নিয়ে ফেলা যায়– এবং সেখানেই সেই মানুষটি লালিত-পালিত হতে থাকে যদি– তবু সে অবশ্যই বেঁচে থাকবে এবং মনুষ্যত্ব লাভ করবে। তবে এ রকম পরিবেশে যে মনুষ্যত্ব সে লাভ করবে সে মনুষ্যত্বের মাধ্যম তার গর্ভধারিণী মায়ের ভাষা হবে না, হবে ভিন্ন পরিবেশে যে ভাষার পরিমণ্ডলে সে বেড়ে উঠল সেই ভাষা এবং সেই ভাষাই হবে তার মাতৃভাষা। এখানেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে: মাতৃভাষা সকলের ক্ষেত্রেই গর্ভধারিণী মায়ের ভাষা নয়, যে ভাষা মাতৃস্বরূপিণী হয়ে পশুত্ব থেকে পৃথক করে মানুষরূপে জন্ম দেয়, সেই ভাষাই মাতৃভাষা। এই মাতৃভাষার কোলেই আমরণ তাকে অবস্থান করতে হয়, সেই কোল থেকে পড়ে গেলেই মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে সে। মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলা মানে তার কবিসত্ত্বাও হারিয়ে ফেলা। কবিসত্ত্বা হারিয়ে ফেলাকে বুদ্ধদেব বসুর অনুসরণেই বলা যায়- মানুষের কাব্য, ইতিহাস ও বিজ্ঞানে জনকত্বকে হারিয়ে ফেলা। এখন ‘কবিতা’ কথাটির সাধারণ ও ব্যাপক অর্থে ব্যবহারকে আপাতত স্থগিত রেখে কেবল যদি বিশুদ্ধ কবিতার কথাই ধরি জীবনানন্দ কবিতার যে অর্থ বিবেচনায় নিয়ে বলেছিলেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’– তাহলে তো মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় সার্থক কবিতা রচনার কথা ভাবাই যায় না। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমাদের বাংলা কাব্যের যুগন্ধর পুরুষ শ্রী মধুসূদনের কথা স্মরণ করাই যথেষ্ট। পরের ভাষায় কবিতা রচনা করে খ্যাতিমান হয়ে ওঠার মোহ থেকে যখন তিনি মুক্ত হলেন, তখন থেকেই ‘মাতৃকোষে রতনের রাজি’র সন্ধান পেয়ে মাতৃভাষায় কবিতা রচনা করে নিজে যেমন তৃপ্ত হলেন, তেমনই মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার সমৃদ্ধি-সাধনে ও গৌরব-বর্ধনে সমর্থ হলেন। মধুসূদনোত্তর কালে বিভাষায় যথেষ্ট পারঙ্গমতা অর্জন করেন যে সব বাঙালি কবি, কবিতা রচনায় তাঁরা কেউই বিভাষা বা পরভাষার আশ্রয় নিয়ে শক্তির অপচয় ঘটাননি। পরভাষা থেকে মধু আহরণ করে মধুভাণ্ড তৈরি করেছেন আপন মাতৃভাষাতেই। এক সময়ে পরভাষার আধিপত্যের হাত থেকে মাতৃভাষাকে বাঁচানোর লক্ষ্যে আমরা সচেতন ও সক্রিয় হয়ে উঠেছিলাম। সেই সচেতনতা ও সক্রিয়তার বিস্তৃতি ঘটার ফলেই আমরা অনেক ভ্রান্তিবিলাসের হাত থেকেও মুক্ত হতে থাকি, হয়ে উঠি মুক্তিসংগ্রামী। মুক্তিসংগ্রামী বাঙালির সংগ্রাম শুধু পরভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধেই ছিল না, ছিল পররাষ্ট্রের শাসন-শোষণ থেকে মুক্তিলাভের জন্য আপন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। মরণপণ সংগ্রামে জয়ী হয়ে যে স্বাধীন স্বরাষ্ট্রটি লাভ করলাম, সে রাষ্ট্র যে পরভাষার আধিপত্য মুক্ত হবে-তেমনটিই তো ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সেই স্বাভাবিক ঘটনাটিই ঘটছে না। ঘটতে দিচ্ছে না আমাদের দেশ ও সমাজের কর্তৃত্বশীল গোষ্ঠী। এখন এই গোষ্ঠীর মানুষগুলো আমাদের স্বভাষী-স্বদেশী হলেও সংখ্যায় তারা লঘু। অথচ স্বাধীন দেশেও পূর্বেকার বিভাষী-বিদেশী শাসক-শোষকদের মতো এ রকম এক বা একাধিক গোষ্ঠীর হাতে শাসিত-শোষিত হওয়াই যেন হয়ে গেল অনিবার্য নিয়তি। পূর্বেকার পরদেশী ও পরভাষী শাসক-শোষকদের মতোই এরাও পরভাষা-প্রেমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করছে প্রতিনিয়ত। ছেলেমেয়েদের পরভাষা-নিপুণ করে তোলা ও স্বভাষা ভুলিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টায় এদের সীমাহীন উৎসাহ। আবার ভণ্ডামিতেও এদের দুর্বার পারঙ্গমতা। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই, কিংবা অন্য যে কোনো সময়েও, শিক্ষার মাধ্যমসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে মাতৃভাষা প্রচলনের বচনামৃত বর্ষিত হয় যাদের মুখ থেকে, একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে যে তাঁদের অনেকেই সন্তানদের শিক্ষাদানের জন্য বেছে নিয়েছেন ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই ভণ্ডরা দেশ ও সমাজে কর্তৃত্বশীল হয়ে থাকবে যতদিন, ততদিন স্বাধীনতার অমৃত ফল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের নাগালের বাইরেই থেকে যাবে। পরাধীন আমলের মতোই পরভাষার পীড়নে মনুষ্যত্ব বিকাশের সব সুযোগ থেকেই বঞ্চিত থাকবে তারা। এ রকম অবাঞ্ছিত অবস্থা থেকে মুক্তি অবশ্যই কাম্য। কিন্তু কারা হবেন সেই মুক্তির দূত? সেই মুক্তিদূতেরা তো দেশজুড়েই এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছেন। এদের ভেতরেই আছেন মুক্তবুদ্ধি ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সমাজচিন্তাবিদ, রাষ্ট্রনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং এ রকম আরো বহু বিষয়েও অনেক অনেক জ্ঞানযোগী ও কর্মযোগী। আজ একান্ত প্রয়োজন দেখা দিয়েছে দেশ ও জাতির প্রকৃত মুক্তির লক্ষ্যে এঁদের সকলের একত্র মিলিত হওয়া-অর্থাৎ সংঘবদ্ধ হওয়া। এঁদের সম্মিলিত শক্তিই পারে ভণ্ডদের কর্তৃত্বশীলতার অবসান ঘটাতে। পারে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ঘরে ঘরে মুক্তিসংগ্রামের অমৃত ফল পৌঁছে দিতে। এ কাজটি করতে গিয়ে এঁরা প্রথমেই নজর দেবেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের উৎসটির সঙ্গে সকলকে সংযুক্ত করে দেয়ার দিকে। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আকুতি থেকেই তো উৎসারিত হয়েছিল আমাদের মাতৃভূমির শৃঙ্খলমুক্তির অভীপ্সা। সেই অভীপ্সা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠার এক পর্যায়ে সংঘটিত হয় সশস্ত্র সংগ্রাম, এবং সে সংগ্রামে বিজয়ের ফল-স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রে সেই বিজয়ের ফলরাশিকে অপহরণ করে নিয়ে গেল যে মুষ্টিমেয় ভণ্ড ও ধড়িবাজ লুটেরারা, তাদের হাত থেকে অপরিমেয় জনগণকে মুক্তি দেয়ার লক্ষ্যেই এখন এগিয়ে আসতে হবে নতুন মুক্তিসংগ্রামীদের। সে সংগ্রামের প্রথম ও অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হবে মনুষ্যত্ব বিকাশের সোপানরূপে সকলের জন্য মাতৃভাষার ব্যবহার বাধামুক্ত ও সুনিশ্চিত করা। এবং স্বাধীন স্বদেশকে পরভাষা বা বিভাষার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ফেলতে চায় যারা, তাদের বদমতলব প্রতিহত করা। তাই বলে বিভাষার চর্চা বন্ধ করা নয়, বরং প্রয়োজন আমাদের মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করা ও বিশ্বের সঙ্গে যোগযুক্ত থাকার জন্য সে চর্চাকে উৎসাহিত করা। কিন্তু সকলের জন্য অবশ্যই বিভাষাচর্চা আবশ্যিক হবে না। এমন বিধিব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যাতে দেশের সকলে মাতৃভাষার মাধ্যমেই আত্মবিকাশে ও আত্মপ্রকাশে সক্ষম হয় এবং সেজন্যে বিভাষার দ্বারস্থ হওয়ার যেন প্রয়োজন না পড়ে। বাংলাদেশে এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে পারলেই এ দেশের বাঙালিসহ অন্য সব জাতিগোষ্ঠীর সকল নাগরিকের জন্যই আপন আপন মাতৃভাষায় মনুষ্যত্ব বিকাশের সুযোগ অবারিত হয়ে যাবে। প্রতিটি নাগরিকের মনুষ্যত্ব বিকাশের প্রতিবন্ধকতা-মুক্ত যে দেশ, সেই দেশই তো প্রকৃত স্বাধীন দেশ। এ রকম স্বাধীনতা লাভ না করা পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামেরই সমাপ্তি ঘটবে না। মুক্তির সংগ্রামে জয়ী হওয়ার কথা তো কল্পনাই করা যাবে না। লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..