সন্তান হঠাৎ করেই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে অবিভাবকদের সামনেই। বিশেষ করে কিশার সন্তানেরা অনেক বেশি অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অপরাধের ধরন সামান্য নয়, মাদক থেকে শুরু করে তা ধর্ষণ, হয়রানি এমনকি হত্যাকাণ্ডের মত অপরাধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ২০১৬ সালে গুলশানে জঙ্গি হামলার সময়ও আমরা লক্ষ করেছি যে সেখানেও ছিল বেশ কয়েকজন কিশোর। বাবা-মায়েরা বুঝতেও পারেননি, সন্তান কীভাবে জড়িয়ে গেলো এতোবড় ভয়ংকর ফাঁদে। ধর্মের দিকে মনোনিবেশ করেছে দেখে অনেক অভিভাবক হয়তো খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু ভাবতেও পারেননি যে সন্তান জঙ্গি হয়ে যাবে। তাই এমনকি সন্তানরা অভিভাবকদের কথা শুনছেন না কিংবা কিশোর ছেলেমেয়েদের অপরাধী হয়ে ওঠার ভয়ে বাবা-মায়ের বেশ চিন্তিত আছেন-এই দু’টো বিষয়ই বর্তমানে সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। বিশেষ করে রাজধানীর কলাবাগানে সম্প্রতি বাসায় ডেকে ‘ও’ লেভেল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর কিশোরী মেয়েটির মৃত্যু আমার বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে যাদের কিশোর সন্তান আছে তাদের সকলকেই একধরনের দুঃশ্চিন্তায় ফেলেছে। তার মধ্যে দু’একজন আবার আরেক কাঠি ওপরে। ছেলে দূরের স্কুলে পড়বে, কোথায়, কী করবে সেই বিষয়ে ব্যাপক দুঃশ্চিন্তা থাকাতে কাচের একটি স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন।
বেশ কয়েকদিন ধরেই চলা কলাবাগানের কিশোরীর মৃত্যু অভিভাবকদের দায় এবং দায়িত্বকেও খোদ প্রশ্নের মুখে নিয়ে গেছে। এ নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্নভাবে। সেখানে কয়েকটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। মেয়েটিকে নিয়েই আলোচনা বেশি। তবে এবার তার কাপড় চোপড় নিয়ে নয়, মেয়েটি কেন গিয়েছিল সেই খালি বাসায়? যেখানে শুধু ছেলেরাই ছিল। অনেকে বলছেন ছেলেটি তাকে তার বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়নি, মেয়েটি নিজেই গিয়েছিল। মেয়েটির বন্ধু বান্ধবদের বয়ান উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে ছেলেটির সঙ্গে মেয়েটির সম্পর্ক ছিল। সম্পর্ক যেহেতু ছিল তাই এটি নিয়ে কথা বলার কিছু নাই। এই শারীরিক সম্পর্কে মেয়েটির সম্মতি ছিল। মেয়েটির বয়স নিয়েও কথাবার্তার শেষ নেই। এরপরের বিষয়টি হচ্ছে অভিভাবকদের দায় এবং দায়িত্বের বিষয়টি। এখানেও মুখ্য হয়ে ওঠেছে মেয়ের বাবা-মায়ের কথা।
আমাদের মনে রাখতে হবে, যখন আপনি বলবেন মেয়েটি কেন গেল? তার মানে কিন্তু এই বিষয়টির আপনি অনুমোদন দিয়ে দেন যে বাংলাদেশে এখন এই অবস্থা যে, যে কেউ কারো বাসায় গেলেও ধর্ষিত হতে পারে। আর একথাও আমাদের মনে রাখতে হবে যে সম্পর্কের ঘেরাটোপে ধর্ষণ বৈধ হয় না। বিশ্বজুড়ে যেখানে বেশিরভাগ দেশে খোদ ম্যারিটার রেইপ নিয়েই আইন রয়েছে এবং বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক সময়ে এটি নিয়ে বড়সড় আলোচনা চলছে তাই সম্পর্কের দোহাই এখানে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সম্পর্কের মধ্যে যেকোনো ধরনের নিপীড়নের বিষয়ে বরং কথা বলা জরুরি এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি।
এখন আসি অভিভাবকদের প্রসঙ্গে। আমরা ইতোমধ্যে জেনে গেছি যে এই ঘটনার পর মেয়েদের অভিভাবকরা অনেকটাই কড়াকড়ির মধ্যে রাখছেন মেয়েদের। এর সঙ্গে শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন কন্যার অভিভাবকরা। তবে এখানে এই কথা বললে খুব বেশি অতুক্তি হবে না যে, এখনকার অনেক অভিভাবকই যতো বেশি জিপিএ ফাইভ, ভালো রেজাল্ট এগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, ঠিক ততোটাই উদাসীন থাকেন সন্তানদের আচার-আচরণ এবং চিন্তাধারা তৈরির ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে। পরিবার যেহেতু শিশুর মানিসকতা এবং আচার-আচরণ গড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথম একক তাই ধারণাই করা হয় যে, পরিবারিক শিক্ষা একজন মানুষের প্রথম শিক্ষা। তবে এটিও ধারণা করা ঠিক হবে না যে, বাবা-মায়েরা ঠিকমত শিক্ষা দিচ্ছেন না, অনেক ক্ষেত্রে সন্তানদের সঙ্গে পেরে ওঠছেন না। সন্তানরা মন খারাপ করছে, আত্মহত্যার হুমকি দিচ্ছে, সন্তান হারানোর ভয়েও অনেক বাবা-মা’কে মেনে নিতে হয় সন্তানদের নানা ধরনের কার্যকলাপ।
সর্ম্পকের দিক থেকেও বাড়ছে দূরত্ব এবং আস্থাহীনতা। অনেক সন্তানই যেমন বাবা-মাকে যেমন ‘বেকডেটেড’ বলে দূরত্ব তৈরি করছে আবার অনেকেই সময়ও পাচ্ছেন না সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটানোর। মোবাইল ফোন অনেকটাই কেড়ে নিচ্ছেন সবার সময়। বাবা একিদকে, একটি মোবাইল নিয়ে, মা আরেকটি নিয়ে, সন্তানরাও মুখ ডুবে রাখছে ফেসবুকে। একই বাসায় থাকলেও কারো কারো সাতে কারো তেমন যোগোযোগ হচ্ছে না। এখন বাসায় থাকলেও সন্তানের যোগাযোগ কার সঙ্গে হচ্ছে, কোন চক্রে সন্তান জড়িয়ে পড়ছে কি-না, বাবা-মা সেটি জানেতেও পারছেন না।
সন্তানদের প্রতি আপত্য স্নেহের অনেক অভিভাবকেই সন্তানের অনেক আপরাধকে আমলে নেন না বা নিতে চান না। এমনকি দেখা যায় যে, শিক্ষক কোনো কারণে শিক্ষার্থীদের বকা দিলেও অভিভাবকরা যোগাযোগ করে শিক্ষককে ওল্টো হেনস্থা করেন। যার কারণে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই এখন শিক্ষার্থীর অপরাধ দেখলেও অভিভাবকদের জানাতে ভয় পান।
এখন এই সমস্যার সমাধান কী? আমাদের দেশে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে সন্তান কোনো ধরনের অপরাধ করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাকে দোষারোপ করা হয়। যেখানে নারীই হচ্ছেন অপরাদের শিকার সেখানে এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে আরেক নারীকেই। পুরুষতান্ত্রিকতা ধরেই নেয় যে সন্তানের দেখভাল করা একমাত্র মায়েরই কাজ। আমি নিশ্চিতভাবেই জানি এ?ই ঘটনার পর অনেক নারীকে শুধুমাত্র কন্যাকে দেখে শুনে রাখার জন্য চাকুরি থেকে ছাড়িয়ে নেবেন তাদের পরিবার। আরও নিশ্চিতভাবেই জানি শোকগ্রস্ত কলাবাগানের সেই ভুক্তভোগীর মাকে এখনিই শুনতে হচ্ছে কেমন মা তিনি যে মেয়েকে একলা যেতে দিয়েছেন। অনেক সাংবাদিকই তাকে এই প্রশ্ন ইতোমধ্যে করে ফেলেছেন। যার উত্তর তিনি দিয়েছেন সন্তান হারানোর মতো মানসিক অবস্থা নিয়েই।
আর কী কী হবে? কিশোরী এবং তরুণ মেয়েরা অনেকটাই ঘরবন্দি হয়ে পড়বেন।
কিন্তু এটি কোনো সমাধান হতে পারে না। সন্তানের অভিভাবক বাবা এবং মা। সেখান এ দু’জনকেই সমভাবে দায়িত্ব ভাগাভাগি করতে হবে। সন্তানের খোঁজখবর রাখতে হবে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং সম্মানের সম্পর্ক রেখেই। সন্তান যেন মনে না করতে পারে যে বাবা-মায়েরা তাদের নজরদারিতে রাখছেন। তাদের বুঝিয়ে বলেন, বাবা-মা’র তাদের অনেক কিছু জানলে তাদের বিপদে থেকে উদ্ধার করা সহজ হবে। সন্তানদের একটা বয়সে বকাবকির চেয়ে বুঝিয়ে কিভাবে বলা যায় সেসব বিষয়ে বাবা মাকে মনোযোগী হতে হবে সবচেয়ে বেশি, বাবা-মায়ের কথা না শুনলে অন্যকোনও আত্মীয়, যার সঙ্গে সন্তান ঘনিষ্ঠ তার সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করুন।
অনেক পরিবার আছে যেখানে নিজেদের পারিবারিক বিষয় অন্যদের জানতে দেয়ার বিপক্ষে। কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় নিজেরা আসলে সমস্যা মিটাতে পারছেনা। তখন অন্যদের সহায়তা নিতে হবে। এছাড়া কাউন্সিলিং প্রক্রিয়াকেও পজিটিভলি দেখতে হবে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কাউন্সিলিং বিষয়টিকে অধিকাংশ মানুষ সহজভাবে নিতে পারছে না।
আরেকটি বিষয় এখানে রাখা প্রয়োজন যে, মেয়ের ক্ষেত্রে পরিবারগুলো যতোটা নজরদারি করে একটি ছেলের ক্ষেত্রে ততোটাই উদাসীন থাকে। কারণ এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ পরিবার মনে করে মেয়ের ওপরও নির্ভর করছে পরিবারের সম্মান। তাই এই সময়ে এসেও দেখা যায় যে, মেয়েদের ওপরই এ ধরনের ঘটনার প্রভাব বেশি হচ্ছে। আমরা এখন নারীকে যতোটানা শেখাচ্ছি নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলতে, ঠিক ততোটাই উদাসীন থাকছি পরিবারের ছেলেদের বিষয়ে। ছেলেদের আচার-আচরণ, মানিসকতা সেটি নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা হচ্ছে না। যার কারণে আসলে থামানো যাচ্ছে না এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কারণ যেসব ছেলে এ ধরনের মানসিকতা পোষণ করছে তারা কোনো ধরনের চ্যালঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে না।
পত্রিকায় যখন এই ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হয় তখন আমরা সেই সংবাদের নিচের কমেন্টগুলো যদি বিশ্লষণ করি তাহলে দেখবো কী পরিমাণ ধর্ষণকামী পুরুষ আমাদের সমাজে আছে এবং কোনো না কোনো পরিবারেই তারা বসবাস করছে। এখন তাহলে পুরষদের ধর্ষকামী মনোভাবের পেছনে পরিবার কী ধরনের ভূমিকা পালন করছে? ‘আমার ছেলে এমন করতেই পারে না’- এ জায়গা থেকে অভিভাবকদের সরে আসতে হবে। এবং যখন জানবেন আপনার ছেলের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা তৈরি হচ্ছে তখনই তাকে নিজেরা শুধরে দেয়ার চেষ্টা করুন। তাদের নারীর প্রতি এবং অন্যান্যদের প্রতি কেমন আচরণ হবে সেই বিষয়ে বেশি বেশি বলুন।
সন্তানের শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবার যেহেতু প্রধান এবং প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান তাই এক্ষেত্রে অভিভাবকদের দায় এড়ানো কঠিন। অনেক অভিভাবকই অত্যন্ত দুর্বল থাকেন সন্তানদের প্রতি। তাই সন্তানকে হারানোর ভয়ে সন্তান বিপথে যাচ্ছেন জেনেও চেষ্টা করেও ফেরাতে পারেন না। সন্তানের সাফল্য যেমন আভিভাবকদের, তেমনি সন্তানের দুর্নামও অভিভাবকদের ওপরই বর্তাবে। তাই সন্তানের ভালো রেজাল্টের পাশাপাশি সন্তান কী মনমানসিকতা লালন করছে সেটি যাচাই করুন সবার আগে। সেটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি।
অনেকেই বলেন আগে বাবা-মায়েরা সন্তানদের মারতো সেটিই ভালো ছিল। মানবিক দোহাইয়ে সেই শারীরিক শাস্তির চল হয়তো নেই কোথাও এখন। অনেক শিক্ষকও শিক্ষার্থীদের বকা দিলে অভিভাবকরা তাদের তিরস্কার করে। আসলে শোধরানোর জায়গাগুলোতেও আমরা অনেকটাই মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছি। তাই দুশ্চিন্তা নিয়ে থাকলেই হবে না, এর থেকে বের হবার চেষ্টাও আমাদেরকেই করতে হবে।
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়