স্থানীয় সংস্থা প্রসঙ্গ- ৩

জাতীয় বাজেট ও স্থানীয় সরকার

এম এম আকাশ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
পটভূমি গভার্নেন্স এডভোকেসি ফোরামের পক্ষ থেকে একটি অতীত সেমিনারে “স্থানীয় সরকারের বাজেট” সম্পর্কে নিম্নোক্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলির কথা তুলে ধরা হয়েছিল-দাবিগুলি ছিল আদায়যোগ্য ও খুবই ন্যূনতম- * গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ তথা প্রকৃত ক্ষমতা ও কর্র্তৃত্বসম্পন্ন শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় বাজেটে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট কার্যপরিধির ভিত্তিতে প্রকৃত বরাদ্দ ১.৪৩ শতাংশ থেকে আরো বৃদ্ধি করা। * তৃণমূলে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলির আর্থিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধির জন্য সংবিধানে প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী তাদের ভূমিকা সুনির্দিষ্ট করা এবং এই লক্ষ্যে সংসদ সদস্য বা প্রশাসনের কর্তৃত্বমুক্ত ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। * সরকারের যেমন কেন্দ্রীয় পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে তেমনই স্থানীয় সরকারেরও অনুরূপ উন্নয়ন পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। পরিকল্পনাটি ‘নিচ থেকে উপরে’ পদ্ধতিতে প্রতিবছর মে মাসের আগেই সম্পন্ন করে সরকারের কাছে প্রেরণ করা, যাতে সরকার তার কেন্দ্রীয় বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় তা সমন্বয় করতে পারে। এক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর পূর্বঘোষিত জেলা বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে কার্যকর করা। * স্থানীয় সরকারকে তাদের আয়-ব্যয় নির্ধারণের লক্ষ্যে আয়ের উৎসগুলি চি?ি?হ্নত করে প্রস্তাব নির্ধারণের সুযোগ সৃষ্টি করা। জাতীয় বাজেট নির্ধারণের সময় এই প্রস্তাবগুলি বিবেচনায় নিয়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে মূল প্রস্তাব প্রণয়ন করা। * স্থানীয় জনগণের কাছে স্থানীয় সরকারগুলির কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। * এ বছর থেকেই ‘স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের’ উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং দারিদ্র্য নিরসন কর্মসূচির ব্যয় পরিকল্পনাগুলি ইন্টারনেট ও অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করা, যাতে গ্রামে/ইউনিয়নে/উপজেলায় কী কী সরকারি প্রকল্প এ বছর বাস্তবায়িত হবে, তাতে কত টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, কারা কারা এই অর্থ ব্যয়ের দায়িত্বে রয়েছেন এবং এখানে কোনো ব্যত্যয় হলে কোথায় অভিযোগ করা যেতে পারে– এ তথ্যগুলো সকলে জানতে পারেন। ইতোমধ্যে ঐসময় ২০১০-১১ সালের চলতি বাজেটটি যখন প্রকাশিত হয়ে আমাদের হাতে আসলো তখন আমরা কী দেখতে পেয়েছিলাম? বরাদ্দ কি বৃদ্ধি পেয়েছিল? আমাদের হিসাব অনুযায়ী আপেক্ষিক বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় সেবার আরো কম! মোট বরাদ্দ বৃদ্ধি পেলেও মোট বাজেটের আয়তন এত বৃহৎ হয়েছে যে আপেক্ষিক বরাদ্দ গতবারের ১.০৭ শতাংশ থেকে কমে ০.৯৭ শতাংশে নেমে গেছে। সংসদ সদস্যদের তত্ত্বাবধানে ব্যয়ের জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে যে পৃথক বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে এটা নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানদের আপত্তি ছিল এবং সবসময় বলা হচ্ছে যে, জাতীয় আইন প্রণয়নই হওয়া উচিত তাদের মুখ্য কাজ। তবে ম্যাক্রো প্রকল্পগুলির যেমন পদ্মা সেতুর মত জাতীয় পরিকল্পনার ক্ষেত্রে তাদের সমন্বয়কারী হিসেবে একটি ভূমিকা পালনের প্রয়োজন থাকতে পারে। আমাদের উল্লিখিত তিন, চার ও পাঁচ নং প্রত্যাশাগুলি চলতি বাজেটে প্রকাশিত নীতি হিসেবে সমর্থিত হলেও সেই লক্ষ্যে কোনো কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণে অর্থমন্ত্রী সেবার সক্ষম হন নি। এ প্রসঙ্গে ঐ বাজেটে অর্থমন্ত্রীর সরল স্বীকারোক্তিটি ছিল নিম্নরূপ- তিনি লিখেছেন, “এ বিষয়ে সরকার মনে করে যে, উন্নয়ন এবং সেবা সরবরাহের সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে। যেসব কর্মকাণ্ড বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যেমন– শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ, গ্রামীণ পূর্তকর্ম ইত্যাদি, সেসব ক্ষেত্রে ব্যাপক বিকেন্দ্রায়নের প্রয়োজন এবং দায়িত্ব ও ক্ষমতার প্রতিসংক্রম অপরিহার্য। সরকার এ-ও মনে করে যে, জেলা পরিষদকে ঢেলে সাজিয়ে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বিলম্বের জন্য আমরা দুঃখিত। তবে এ মহান সংসদকে আমি অবহিত করতে পারি যে, এ বিষয়টি বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সবিশেষ নজরে আছে। ” (বাজেট বক্তৃতা, পৃষ্ঠা: ৭২) প্রশ্ন হচ্ছে “এই নজরে” রাখা আর “দৃশ্যমান” হওয়ার মধ্যে ব্যবধান আজ আট বছর পরে ২০১৮ সালে কেন অব্যাহত শুধু নয়, বেড়েই চলেছে! অর্থমন্ত্রীর আন্তরিকতা বনাম সরকারের ক্ষমতা ভিত্তি ভুল স্বীকার ও দুঃখ প্রকাশের পরও আমাদের সন্দেহ থেকে যায় যে, গতানুগতিক বাজেটের বৃত্ত থেকে সরকার আগামীতেও বেরোতে পারবেন কি? এরজন্য শক্তিশালী আমলাতন্ত্র এবং সাংসদদের সঙ্গে সরকারকে অনেক সংগ্রাম করে অগ্রসর হতে হবে। এই উভয় গ্রুপের মধ্যেই অপেক্ষাকৃত ধনীদের প্রভাবের কথা সুবিদিত। সম্প্রতি সরকার তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সম্পত্তির হিসাব প্রকাশের বিষয়টি থেকেও পিছিয়ে আসছে বলেও মনে হচ্ছে। লক্ষণীয় যে, পরবর্তী প্রস্তাবিত বাজেটগুলিও গতানুগতিক ধারাতেই প্রণীত হয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতায় আসার আগেই অর্থমন্ত্রী যা যা করার স্বপ্ন দেখেছিলেন তার সময়কালে তা তিনি করতে সক্ষম হন নি। ক্ষমতায় আসার বছর দুয়েক আগে লেখা তদানিন্তন অর্থমন্ত্রীর নিজস্ব স্বপ্নের একটি বিবরণ আমি এখানে তুলে ধরতে চাই। ফেব্রুয়ারি ২০০৭ সালে প্রকাশিত অর্থমন্ত্রীর একটি গ্রন্থের (An Agenda for Good Governance: From Lawlessness and Corruption to a Caring and Prosperous Democracy, Shahittaya Prokash, February, 2007) ১০৮ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছিলেন, “সরকারের কার্যপ্রণালী বিশ্লেষণের জন্য আমরা এই দুই স্তরে বিষয়টি দেখার জন্য অনুরোধ করবো। প্রথমত, স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে করণীয়গুলি কী? এবং তারপর জাতীয় সরকারকে পুনর্গঠিত করার জন্য করণীয়গুলি কী? বাংলাদেশ সরকার নামটি উচ্চারণ করলেই এখন মনে হয়, বলপ্রয়োগে ক্ষমতার অপব্যবহার, সন্ত্রাসীদের পরিপোষণ, আইনের শাসনকে পরিহাসে রূপান্তরিত করা, রাষ্ট্রক্ষমতার অতিকেন্দ্রীকরণ, সর্বত্র দ্বৈততা এবং অতিরিক্ততা (Duplication and Redundancy), জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং সুদূরে অবস্থান গ্রহণ, সর্বত্র জবাবদিহিতা ও তত্ত্বাবধানের অনুপস্থিতি এবং সীমাহীন দুর্নীতি। এখানে আমি এমন একটি কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রস্তাব করছি যার মাধ্যমে জেলা সরকার হবে সকল উন্নয়নমূলক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক সরকারি ক্রিয়াকাণ্ডের মূল কেন্দ্র। এরফলে কেন্দ্রীয় সরকার আকারে ছোট হয়ে আসবে; অধিকতর দক্ষ হয়ে উঠবে এবং তার আওতাধীন বিষয়গুলি সীমাবদ্ধ থাকবে শুধুমাত্র সেইসব বিষয়ে যেগুলির রয়েছে জাতীয় গুরুত্ব, যেগুলি জাতীয় নীতি, জাতীয় লক্ষ্য এবং জাতীয় সাধারণ মানের (Standard) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়। এটা হবে ৬৭টি জেলায় ৬৭ জন নির্বাচিত চেয়ারম্যান, যাদের পদের পদবী হবে মন্ত্রীর সমতুল্য, তাদের কাছে কার্যকর সরকারি ক্ষমতার হস্তান্তরের সামিল। রাজধানীতে থাকবে শুধু একটি ছোট কেবিনেট, যার সদস্য সংখ্যা ২৫-এর বেশি হবে না। আমি বলতে চাই, এই ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন এক ঢিলে সাতটি জাতীয় মন্দকে (ঊারষ) আঘাত করবে: ১. গভীর রাজনৈতিক বিভাজন ২. সুবিশাল ও কেন্দ্রীভূত শ্বেতহস্তীর আমলাতন্ত্র ৩. কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতা ৪. একটি কেন্দ্রীভূত রাজস্ব আহরণ পদ্ধতির ক্ষীণ বিস্তৃতি ৫. সরকারি কর্মচারীদের নিয়মিত জবাবদিহিতা ও তত্ত্বাবধানের অভাব ৬. জনগণ থেকে দূরে অবস্থিত একটি দুর্নীতিপরায়ণ সরকার ৭. সরকারি কার্যক্রমে এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণের পরিপূর্ণ অংশগ্রহণহীনতা।’’ (পৃ: ১০৯) এরপরে উক্ত গ্রন্থে জনাব মুহিত জেলার নির্বাচিত সরকার কীভাবে গঠিত হবে তার বিস্তৃত পরিকল্পনা প্রদান করেছেন। তিনি বর্তমান স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রী নামে কেন্দ্রে যে মন্ত্রী ও পদ রয়েছে তা বিলুপ্ত করে ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ গঠনের সুপারিশ করেছেন যার কাজ হবে স্থানীয় সরকারগুলির তত্ত্বাবধান বা দেখভাল করা। এছাড়া ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রধান কাজ বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, তারা মূলত তলা থেকে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন এবং তার বাস্তবায়নের জন্য সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন। তৃণমূলে ইউনিয়ন পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রসঙ্গে প্রদত্ত আরো একটি তাৎপর্যময় বক্তব্য আমি নিচে উদ্ধৃত করছি, ‘‘প্রতিবছর প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে জনগণের দুটি সাধারণ সভার আয়োজনের সুযোগ রাখা হবে। এই সভায় সভাপতিত্ব করবেন ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেখানে উপস্থিত থাকবেন। সভার আলোচ্যসূচি হবে বিস্তৃত ও উন্মুক্ত (Wide and Open) এবং মূলত বাজেট ও পরিকল্পনা কেন্দ্রিক। অন্য আরো অনেক সভা তৃণমূলে হতে পারে কিন্তু এ দুটি সভা হবে বাধ্যতামূলক।’’ (পৃ: ১২৯) অর্থমন্ত্রীর স্বপ্ন কি অবাস্তব বা অসম্ভব স্বপ্ন? এ ধরনের স্বপ্ন কি আসলেই ধরাছোঁয়ার অতীত কোনো স্বপ্ন? আমার তা মনে হয় না। ইতোমধ্যেই নিজস্ব উদ্যোগে এবং ইউএনডিপি’র স্থানীয় সরকার গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে অথবা সুশীল সমাজের কোনো কোনো সংগঠনের উদ্যোগে পরীক্ষামূলকভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে নিজস্ব পরিকল্পিত বাজেটভিত্তিক উন্নয়ন কর্ম পরিচালিত হচ্ছে। এসব উদ্যোগের রাষ্ট্র চরিত্রের কারণে সীমাবদ্ধতা আছে, ত্রুটিও আছে, কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশে অসম্ভব নয়, তা প্রমাণিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এমনকি গ্রাম পর্যায়ে গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিও সাধারণ সভায় এ ধরনের পরিকল্পিত বাজেট প্রণয়ন করে উন্নয়ন পরিকল্পনা কার্যকরী করছে। তেভাগার রজতজয়ন্তীতে কমরেড অমল সেন, আমি ও শামসুজ্জামান সেলিম’সহ আমরা কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণে গিয়ে সরেজমিনে দেখে এসেছিলাম। তখন একটি সভায় “সুকুমারী” নামের একজন নির্বাচিত নারী বলেছিলেন- “এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা আমাকে আমার নিজস্ব পরিচয় ফিরিয়ে দিয়েছে, আমি এখন কারো মা, কারো স্ত্রী বা কারো কন্যামাত্র নই, আমি নির্বাচিত প্রতিনিধি “সুকুমারী”!” সম্প্রতি আরো বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা জনসমর্থনের শক্তি প্রত্যক্ষ করেছি ভারতের বামপ্রধান রাজ্য কেরালায়, সেখানে মাত্র ২১ বছরের আর্য্য রাজেন্দ্রন মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছেন। জেলা বাজেট পরিপত্র এরপরেও স্বীকার করবো যে, এবারের বাজেটে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমী সংযোজন হচ্ছে: ‘একীভূত বাজেট ও জেলা বাজেট একটি ধারণাপত্র’। সঠিকভাবেই এই ধারণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০১৭ সালের মধ্যে দুই অংকের প্রবৃদ্ধি অর্জন বর্তমান বাজেটের যে উন্নযন ব্যয় কাঠামো তা দিয়ে সম্ভব নয়। সরকারি বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হার বৃদ্ধির চাবিকাঠি হচ্ছে স্থানীয় সরকারকে কেন্দ্রীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার মূল নায়কে পরিণত করা। কিন্তু এই ধারণাপত্রের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে ‘অনুন্নয়ন ব্যয় ও উন্নয়ন ব্যয়’ একীভূত করা যায় কীভাবে তার আলোচনা। বিকেন্দ্রীভূত জেলা বাজেটের আলোচনা করতে গিয়ে বড় অংশজুড়ে যেটা করা হয়েছে তা হচ্ছে, আয়-ব্যয়ের বর্তমান বিবরণীতে নতুন কোড যুক্ত করে তথ্যের এমন ‘শ্রেণিবিন্যাস’ প্রণয়ন যাতে করে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বর্তমান মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ব্যয়কে আঞ্চলিক ব্যয় বিন্যাসে রূপান্তরিত করতে পারি। এ ধরনের নিছক কোডিং পদ্ধতির পরিবর্তন দ্বারা আমাদের অত্যন্ত সীমিত অগ্রগতি সম্ভব। আমরা এর ফলে বর্তমান বাজেট কাঠামোর মধ্যেই আঞ্চলিক বৈষম্যের মাত্রা কতটুকু সেটাই শুধু বুঝতে পারবো, এর বেশি কিছু নয়। জেলা বাজেট প্রণয়নের পেছনে ধারণাপত্রে অন্য যে যুক্তিগুলি তুলে ধরা হয়েছে, যেমন– ১. “ব্যয় প্রাক্কলন প্রণয়নে জনগণের ইচ্ছার বা তাঁদের চাহিদার যথাযথ প্রতিফলন ঘটানো; ২. সম্ভাবনাময় জেলাগুলির জন্য আশানুরূপ স্থানীয় সম্পদ সংগ্রহ ও আর্থিকভাবে তাদের কেন্দ্র নির্ভরতা হ্রাস; ৩. সম্ভাবনাময় জেলাগুলির জন্য কেন্দ্র থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার ব্যাপারে ম্যাচিং গ্রান্টের মাধ্যমে বাড়তি প্রণোদনা সৃষ্টি; ৪. বাজেট বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ জোরদার করা।” (পৃষ্ঠা: ১০ দ্র., ধারণাপত্র) এই পরবর্তী সংস্কারগুলি ছাড়া শুধু হিসাবের বিকেন্দ্রীকরণ দিয়ে স্থানীয় সরকারের প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ অর্জন করা আদৌ সম্ভব হবে না। এই সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বিদায়প্রাপ্ত অর্থমন্ত্রীর চেয়ে ভাল আর কে জানেন। নতুন অর্থমন্ত্রী ও সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ কিন্তু আজো এসব ব্যাপারে সক্রিয় হন নি। তাই আজো আমরা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের দাবির পেছনে পেছনে ছুটছি। আমরা বামপন্থিরা, গ্রামের কৃষক ও ক্ষেতমজুররা, সকল তৃণমূলের নির্বাচিত জনমুখী চেয়ারম্যান-মেম্বার প্রতিনিধিরা, শহরের গণমুখী নাগরিকরা, বুদ্ধিজীবীরা, গ্রামের মেহনতীদের জ্ঞাতি ভাই শহরের শ্রমজীবীরা, ইত্যাদি সকলে মিলে জাতীয়ভাবে চাপ দিয়ে, আন্দোলন করে, জনমত সৃষ্টি করে ৭২ এর সংবিধানের স্থানীয় সরকারের নির্দেশনা, সরকারের দেয়া মৌখিক প্রতিশ্রুতি ও এই জরুরি দাবিগুলি, আমাদেরকে আজ আদায় করে নিতে হবে। উপসংহার ও সুপারিশসমূহ আমরা আমাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মূল তিনটি বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ তুলে ধরতে চাই: ক) চলতি বছরেই কয়েকটি নমুনা জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদে স্থানীয় পর্যায়ে অংশীদারিত্বমূলক বাজেট ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের পাইলট উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। সরকারকেই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। খ) জেলা পরিষদকে নির্বাচিত কর্তৃপক্ষের অধীনে ন্যস্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং সরকারের প্রস্তাবিত জেলা বাজেটে ‘জেলা কর্তৃপক্ষের’ সংজ্ঞা কী হবে তা সুস্পষ্ট করতে হবে। গ) উপজেলা নির্বাহী অফিসার-উপজেলা চেয়ারম্যান-ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-সাংসদ ইত্যাদি খেলোয়াড়দের সুনির্দিষ্ট ক্ষমতা ও দায়িত্ব চিহ্নিত করে তাদের ওপর জনগণের গণতান্ত্রিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার ব্যবস্থা করা হোক। পাশাপাশি, উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলির অনুসরণে ‘Right to Recall’ এবং এদের বিরুদ্ধে জনগণের অভিযোগগুলি গ্রহণ ও শুনানির জন্য একটি স্থায়ী ‘বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার কমিশন’ গঠন করতে হবে। [কৃতজ্ঞতা : এই প্রবন্ধটির মূল ভাষ্যটি ২২ জুলাই ২০১০ সালে প্রথম পঠিত হয় বন্ধুবর জনাব মোহসীন আলি আয়োজিত গভর্নেন্স অ্যাডভোকেসী ফোরাম আয়েজিত এক জাতীয় সেমিনারে। একতায় প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায়, এটি ঈষৎ পরিবর্তন করে ও সংক্ষিপ্ত আকারে পুনর্মুদ্রিত করা হলো।] লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিবি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..