কমছেই না ধর্ষণ
সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদ্বিগ্নতার বিষয় হচ্ছে, সংখ্যা ও ভয়াবহতার দিক থেকে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার ঘটনা বাড়লেও প্রতিরোধের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে দেখা যায় এক ধরণের নির্লিপ্ততা।
গত ৭ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগানে এক স্কুলছাত্রীকে (১৭) ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এই মামলার একমাত্র আসামি তানভীর ইফতেখার দিহানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্কুলছাত্রীর পরিবার বলেছে, ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করেছে বখাটেরা। নারীকে যেসব বিষয় অনিরাপদ করে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে ধর্ষণ। সমাজে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি তা ধর্ষণের ঘটনাকে উৎসাহিত করে। ধর্ষণের দীর্ঘমেয়াদী বিচারের প্রক্রিয়া এই অপরাধকে বাড়িয়ে দেয় আরো কয়েক গুণ। আইনের ফাঁকফোকর আর দীর্ঘসূত্রতার কারণে হয় এসব অপরাধের বিচার হয় না অথবা অনেক সময় অপরাধী আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে আবারও একই রকমের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
এ দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ জন নারী কিংবা শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য মতে, ২০২০ সালের মোট ৩৪৪০ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তন্মধ্যে ১০৭৪ জন ধর্ষণ, ২৩৬ জন গণধর্ষণ ও ৩৩ জন ধর্ষণের পর হত্যা ও ৩ জন ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যাসহ মোট ১৩৪৬ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এছাড়া ২০০ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ৪৩ জন। ৭৪ জন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এসিডদগ্ধের শিকার হয়েছেন ২৫ জন, তন্মধ্যে এসিডদগ্ধের কারণে মৃত্যু হয় ৪ জনের। অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছেন ২৯ জন, তন্মধ্যে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ৫৯ জন। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে মোট ১২৫ জন। পাচারের শিকার হয়েছে ১০১ জন, তন্মধ্যে পতিতালয়ে বিক্রি ৪ জন। বিভিন্ন কারণে ৪৬৮ জন নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও ৩৫ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। যৌতুকের কারণে নির্যাতন হয়েছেন ১১৭ জন, তন্মধ্যে ৫২ জনকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৫৯ জন। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে ১৬৪ জনকে বাধ্য করা হয়েছে। ২৫২ জন নারী ও কন্যাশিশুর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ১১৭টি। তন্মধ্যে বাল্যবিয়ের চেষ্টা হয়েছে ৩৩টি ঘটনা। সাইবার ক্রাইম অপরাধের শিকার হয়েছে ৪৩ জন।
২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দুই বছর আগের তুলনায় এ সংখ্যা দ্বিগুণ। ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৭৩২ জন নারী, ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৪১৩ জন। সরকারি এক হিসেবে বলা হয়েছে অনলাইনে ৭০ শতাংশের বেশি নারী হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। এমনকি নারীরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করতেও পারেন না। এ ছাড়া ধর্ষণের মাধ্যমে জীবননাশের হুমকিও চলে আসে কখনো কখনো। ধর্ষণের মতো অপরাধ প্রতিরোধে বর্তমান প্রজন্মের মনন ও মনোজগৎ পরিবর্তন করতে হবে।
নারী ও পুরুষের মধ্যকার অসমতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা এখনো বিরাজমান। আরও বেশি দুঃখজনক ঘটনা হলো, বাংলাদেশে এমন অনেক সহিংসতা আছে, যা রাষ্ট্রই ঘটায় বা রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
বাংলাদেশে বর্তমানে অনেক আইন প্রণয়ন করলেও এর যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। তাই শুধু আইন প্রণয়ন নয়, এর যথাযথ প্রয়োগ প্রয়োজন, প্রয়োজন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সামাজিক সচেতনতার বিষয়টি এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নয়তো এই সহিংসতা চলতেই থাকবে। নারীর প্রতি সামগ্রিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে ধর্ষণ কমবে না। তাই নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সকলকেই রুখে দাঁড়াতে হবে। সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধেই বন্ধ হবে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ-গণধর্ষণ।
সম্পাদকীয়
অমঙ্গল দূর হোক
Login to comment..