জাতীয় অধ্যাপক ড. প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী

মহেশ চন্দ্র শর্মা

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

এদেশের প্রকৌশল পেশায় যে কয়জন প্রথিতযশা প্রকৌশলী বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছিলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী তাদের মধ্যে অন্যতম। জাতীয় অধ্যাপক ড. প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রকৌশলী সমাজের অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়ে এদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে সার্বজনীন স্বীকৃত পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত পুর প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ, গবেষক, প্রশাসক ও এ জাতির নেতা ছিলেন। প্রকৌশল শিক্ষার প্রাথমিক ধাপে পুরকৌশল নিয়ে পড়াশোনা করলেও বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা, পেশাগত নেতৃত্বের দক্ষতায় এবং মেধায় স্বীকৃতি হিসাবে ক্রমেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন এদেশের সব ধরনের প্রকৌশল প্রকল্পের পরামর্শক টিমের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিবার্য ব্যক্তিত্ব। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ছাড়া সাম্প্রতিক কালে এদেশের কোনো বড় ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। বিশেষত যে সকল প্রকল্পের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন সেগুলি হলো- পূর্বপশ্চিম সংযোগ প্রকল্প, যমুনা বহুমুখী সেতু, সর্বশেষ পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক দলের নেতৃত্বের দায়িত্ব ওনার কাঁধে দিয়ে সবাই নির্ভার ছিলেন। যমুনা নদীর প্রবাহ ধারায় এদেশ পূর্ব ও পশ্চিম দুই ভাগে বিভক্ত। এই দুই অংশের মাঝে বিদুৎ সংযোগের প্রয়োজনে একটি প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল দাতা দেশের সুপারিশ মোতাবেক এক বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে। সুনামধারী এই প্রতিষ্ঠান বিদুৎ সংযোগের এই মস্ত বড় প্রকল্পের জন্য নদীতে স্থাপন উপযোগী স্তম্ভ সমূহের ডিজাইন করলেন প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের পদাধিকারী প্রকৌশলীগণ। তৎকালীন মন্ত্রী মহোদয় ভাবলেন, দেশীয় প্রকৌশলীদের দিয়ে ডিজাইন যাচাই করা হলে এই দেশীয় প্রকৌশলী বড় প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পাবেন পাশাপাশি ডিজাইনটিও যাচাই করা হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে আপত্তি করলেও বিদেশি প্রতিষ্ঠানটি এই দেশীয় পরামর্শকদের সাথে কাজ করতে রাজি হতে বাধ্য হন। দেশীয় পরামর্শক দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী। জামিলুর রেজা চৌধুরী ডিজাইনে ভুল খুঁজে পেলেন এবং তা কর্তৃপক্ষের নজরে আনলেন। বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ডিজাইন পুনঃযাচাই করার অনুরোধ করা হলে তারা ক্ষেপে যান। কিন্তু কিছুই করার নেই, ডিজাইন যাচাই করে দেখা গেল, ডিজাইনে ত্রুটি রয়েছে। এই ঘটনার মধ্যদিয়ে প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী দেশীয় প্রকৌশলী সমাজের সাথে সাথে বিদেশি প্রকৌশলীদের কাছ থেকেও আস্থা ও সমীহ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে আলোর মুগ্ধতা তিনি ছড়িয়েছেন সারা বিশ্ব জুড়ে নিজের মেধা দিয়ে। আজও তার আবিষ্কার করা সূত্র অনুযায়ী প্রকৌশল শিক্ষায় জটিল কাঠামো বিশ্লেষণ করা হয়। যুগের বাতিঘর অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৪২ সালের ১৫ নভেম্বর জন্মেছিলেন পূণ্যভূমি সিলেটের এক উচ্চ শিক্ষিত পরিবারে। বাবা প্রকৌশলী আবিদ রেজা চৌধুরী (১৯০৫-১৯৯১) ব্রিটিশ রাজত্ব থেকে দেশে স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫২ সালে ভারতের আসাম থেকে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন । অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর বাবা ১৯২৯ সালের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড সাইন্স বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রথম মুসলিম হিসাবে প্রকৌশল ডিগ্রী অর্জন করেন। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, মা হায়াতুন নেছা চৌধুরী (১৯২১-২০১০) ও বাবা আবিদ রেজা চৌধুরীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় অর্থাৎ মধ্যমণি। বাস্তব জীবনেও উনি নিজের পরিবারের মধ্যমণি থেকে এই দেশের মধ্যমণি হয়ে উঠেছিলেন। ওনার পেশাগত দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার জন্য ১৯৯৬ সালে র্নিদলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। বাবার চাকুরি বদলির কারণে ১৯৫০ সালে প্রথম ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে ৬ (ছয়) বছর বয়সে শিক্ষা জীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে পরিবার ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে ১৯৫৩ সালে ভর্তির পূর্বে ১৯৫২ সালে নওয়াবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় হতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। ১৯৫৭-৫৯ সাল ঢাকা কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন, বর্তমান বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হতে পুরকৌশলে ১৯৬৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এই কৃতি মেধাবী মানুষটি প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেন এবং স্নাতক পরীক্ষায় রেকর্ড পর্যায়ের নম্বর পাওয়ার কৃত্বিত্ব অর্জন করেন। একই বিভাগে তিনি শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। বিলেতের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রকৌশলে মাস্টার্স এবং ১৯৬৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও ওনার গবেষণার কৃতিত্ব স্বরূপ ম্যানচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরীকে ২০ অক্টোবর ২০১০ সালে সম্মানসূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি প্রদান করেন। এখানে উল্লেখ্য যে তিনিই বাংলাদেশি হিসাবে প্রথম এমন মর্যাদাপূর্ণ সম্মান অর্জন করেন। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পরীক্ষায় ফলাফল প্রকাশের পর বিভাগীয় প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য তিনি বিভাগীয় প্রধানের কক্ষে গেলে অভিনন্দন ও সৌজন্য বিনিময়ের পর বিভাগীয় প্রধান তার প্রিয় ছাত্রকে, শিক্ষকতা করার জন্য ক্লাস রুমে যাওয়ার কথা বলেন। এভাবেই দাপ্তারিকভাবে নিয়মমাফিক অনুমোদনের পূর্বেই জামিলুর রেজা চৌধুরীর শিক্ষক জীবন শুরু হয়। ১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাসে ওনাকে পুরকৌশল বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। বৃত্তি নিয়ে ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি কাঠামোগত প্রকৌশল বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন এবং ঈজঅঈকঝ ওঘ ঈঙঘঈজঊঞঝ ইঊঅগ টঝওঘএ ঈঙগচটঞঊজ অওউঊউ উঊঝওএঘ বিষয়ে গবেষণা করে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন এবং ঝঐঊঅজ ডঅখখ অঘউ ঝঞজটঈঞটজঅখ অঘঅখণঝওঝ ঙঋ ঐওএঐ জওঝঊ ইটওখউঘএ শীর্ষক অভিসর্ন্দভের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বিলেত থেকে তিনি দেশে ফিরে নিজের প্রিয় শিক্ষাঙ্গনে সহকারি অধ্যাপক হিসাবে ১৯৬৮ সালে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে তিনি সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৯৭৬ সালে অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি চঙঝঞ উঙঈঞঙজঅখ ঋঊখখঙঝঐওচ নিয়ে বিলেতের বিখ্যাত ঝটজজঊণ টঘওঠঊজঝওঞণ তে গবেষণার জন্য বৃত্তিলাভ করেন। ২০০১ সাল পর্যন্ত পুরকৌশল বিভাগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েটে) অধ্যাপনা করেন এবং দেশে একটি পূর্ণাঙ্গ কম্পিউটার সেন্টার স্থাপনের কাজে মূখ্য ভূমিকা রাখেন। তিনি পরিচালক হিসাবে বুয়েট কম্পিউটার সেন্টার গঠনে উদ্যোগ নেন এবং দশ বছরের মত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০১ সালে উপাচার্য হিসাবে যোগদান করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। এমন কৃতি মানুষ শুধুমাত্র শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত ছিলেন তা নয় এই দেশের প্রতিটি প্রকৌশল ক্ষেত্রের অগ্রগতির ক্ষেত্রে ওনার অবদান উজ্জ্বল একজন পুরোহিতের মত না হয়ে কোন উপায় ছিল না। উবাবষড়ঢ়রহম ঝড়ভঃধিৎব ঊীঢ়ড়ৎঃ ্ ওঞ ওহভৎধপঃঁৎব রহ ইধহমষধফবংয, বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান হিসাবে ১৯৯৭ সাল হতে ২০০০ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়ার্ড কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। উনি সবসময় বলতেন গণিত অলিম্পিয়ার্ডে এই দেশের গণিতবিদগণ একদিন স্বর্ণ পদক অর্জন করবে। সেই স্বপ্ন সত্যি হলেও এখনো বাকি রয়েছে বিজ্ঞানে নোবেল পদক অর্জন। একদিন ওনার সেই স্বপ্নও সফল হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে সম্মানিত করেছে এমন পদকের তালিকায় উল্লেখযোগ্য হল– একুশে পদক, ২০১৭; শেলটেক পদক, ২০১০; আই ই বি স্বর্ণ পদক, ১৯৯৮; ড. রশীদ গোল্ড মেডেল, ১৯৯৭; স্টার লাইফ টাইম এওয়ার্ড বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক-২০১৮ সালে প্রকৌশলী হিসাবে জাতীয় অধ্যাপকের স্বীকৃতি অর্জন করেন। জীবনে অনেক বিষয়ে তিনি প্রথম ছিলেন তার তালিকায় বিলেত হতে প্রকৌশল পেশায় প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন, প্রথম প্রকৌশলী হিসাবে একুশে পদক ও জাতীয় অধ্যাপকের স্বীকৃতি পান। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এলামনি এসোসিয়েশনের উদ্যোগেরও একজন অন্যতম উদ্যোক্তা এবং আজীবন সভাপতির দায়িত্ব পালন করে গেছেন। খেলাধুলায় অত্যন্ত পারদর্শী এই মানুষটি ফুটবল খেলায় অনেক সময় ব্যয় করেছেন এবং ফুটবল ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংগঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। উনি পছন্দ করতেন রবীন্দ্র সংগীত শুনতে। মহামারি করোনাকালে ২৮ এপ্রিল ২০২০ সালে এই মেধাবী মানবিক প্রকৌশলী সুদীর্ঘ কর্মময় জীবন পিছনে ফেলে অনন্তের যাত্রায় সামিল হন। লেখক : প্রকৌশলী ও ব্যাংকার

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..