একতা বিদেশ ডেস্ক :
বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পেয়েছে সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসের দল মুভমেন্ট ফর সোশ্যালিজম পার্টি। যাকে আখ্যায়িতকরা হচ্ছে ‘দুর্দান্ত ফিরে আসা’। ২০১৯ সালের নির্বাচনে ইভো মোরালেস জয়ী হবার পরেও সেই নির্বাচনের ফলাফল মানতে অস্বীকার করে দক্ষিণপন্থীরা। সরাসরি মার্কিন মদতে শুরু হয় নৈরাজ্য,শেষে অভ্যুত্থান। দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন মোরালেস। এক বছর পরে ১৮ অক্টোবর নির্বাচনে তাঁর দল জিতেছে বিপুল ভোটে। মোরালেস মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী লুইস আরসে রাষ্ট্রপতি পদে জিতেছেন। অভ্যুত্থানে বসে পড়া সরকারের মদতপ্রাপ্ত কার্লোস মেসা অনেক ব্যবধানে হেরে গিয়েছেন। সংসদেও অনায়াস গরিষ্ঠতা পেতে চলেছে মুভমেন্ট ফর সোশ?্যালিজম (এমএএস)।
নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী প্রথম রাউন্ডের ভোটে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেলে সরাসরি জয়। অন্যথায় দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে হবে। আরসে প্রথম রাউন্ডেই ৫২.৪ শতাংশ পেয়েছেন। অভ্যুত্থানের সরকারের মদতপ্রাপ্ত সিটিজেন কমিউনিটি প্রার্থী ও দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কার্লোস মেসা পেয়েছেন ৩১.৫ শতাংশ ভোট। ‘উই বিলিভ’ জোটের প্রার্থী লুইস ফার্নান্ডো কামাচো পেয়েছেন ১৪.১ শতাংশ ভোট। দক্ষিণপন্থীরা এই ভোটের ফলাফল মেনে নেবে কিনা,সংঘর্ষ শুরু হয়ে যাবে কিনা,তা নিয়ে আশঙ্কা ছিল। কিন্তু যেভাবে একের পর এক প্রদেশে ঢেলে ভোট পেয়েছে এমএএস,তাতে আর হিংসার পথে যাবার সাহস কুলোয়নি বিরোধীদের। অভ্যুত্থানে ‘রাষ্ট্রপতি’ হওয়া জেনিন আনেজ নিজে আর ভোটে দাঁড়াতে সাহস করেননি। তিনি এদিন টুইটে স্বীকার করে নিয়েছেন,আরসে জয়ী হয়েছেন। লা পাজে আরসে জয়ের কথা জানিয়ে বলেছেন,‘আমরা আমাদের আত্মা ফিরে পেয়েছি,গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছি,সর্বোপরি আশার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছি। সমস্ত বলিভিয়ানদের জন্য সরকার চালাবো আমরা,দেশকে ঐক্যবদ্ধ করব’।
তার আগেই,যাঁর ছায়া এই নির্বাচনে ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ,বুয়েনস আয়ার্সে নির্বাসনে থাকা সেই ইভো মোরালেস সাংবাদিকদের কাছে জয়ের সংবাদ দেন। তিনি বলেন,জনগণের ইচ্ছা জয়ী হয়েছে। আমরা বিপুল জয় পেয়েছি। মোরালেস ২০০৬ থেকে বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি ছিলেন। বলিভিয়ার আদি অধিবাসীদের মধ্যে প্রথম তিনিই হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি। কৃষক,শ্রমিক,গরিব মানুষের আন্দোলনের নেতা মোরালেস দেশকে দিয়েছিলেন বামমুখী অভিমুখ। একের পর এক গণমুখী সংস্কারে পালটে দিয়েছিলেন বলিভিয়ার চেহারা। লাতিন আমেরিকায় বামমুখী পরিবর্তনের সারিতে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর সরকার হটাতে সরাসরি ওয়াশিংটন থেকে ষড়যন্ত্র হয়। পরিকল্পিত ভাবে নৈরাজ্য ও হিংসার পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। ২০১৯-এ তাঁকে সরে যেতে এবং নির্বাসনে যেতেও বাধ্য করা হয়।
লাতিন আমেরিকায় বামমুখী পরিবর্তনের যে প্রবাহ একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে এক নতুন বাতাবরণের জন্ম দিয়েছিল,সাম্প্রতিক সময়ে তা কিছু পরিমাণ ধাক্কা খায়। বলিভিয়ার নির্বাচনের এই ফলাফল আবার এক নতুন মোড়ে দাঁড় করালো এই মহাদেশকে।
অভিনন্দন জানিয়েছেন একের পর এক বামপন্থি রাষ্ট্রপতি ও দলগুলি। কিউবার রাষ্ট্রপতি মিগুয়েল দিয়াজ ক্যানেল বলেছেন,‘সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের নির্দেশে যে অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তা ফিরিয়ে এনেছেন বলিভিয়ার জনগণ। কিউবা এই আনন্দের অংশীদার। বলিভিয়ারান মতাদর্শের জয়।’ ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি নিকোলাস মাদুরো বলেছেন,‘মহান জয়! ঐক্যবদ্ধ ও সতর্ক বলিভিয়ার জনগণ আমাদের সহোদর ইভোর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানকে পরাস্ত করতে ভোটকে ব্যবহার করেছেন।’ ২০০৯-এ এমনই অভ্যুত্থানে অপসারিত হন্ডুরাসের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ম্যানুয়েল জেলায়া অভ্যুত্থান এবং প্রতারণাকে পরাভূত করার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন বলিভিয়ার মানুষকে। লা পাজ,কোচাবাম্বা সহ দেশজুড়ে এই জয়ের সংবাদে মিছিল,উৎসব শুরু হয়ে যায়। আতশবাজি জ্বালানো হয়। এই জয় শুধু নির্বাচনী প্রচারে আসেনি। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোরালেস সরকারকে হটাতে আক্রমণ ও অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিরোধ করেছিলেন শত শত মানুষ। মোরালেস চলে যেতে বাধ্য হবার পরেও প্রতিরোধ চলতে থাকে। এমএএস’র কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে নামিয়ে আনা হয় পুলিশি সন্ত্রাস,কারারুদ্ধ করা হয়। আনেজ সরকার গণহত্যার অভিযানে নামে। সাকাবা,সেনকাটা,পেদ্রেগাল,ইয়াপাচানি সহ দেশের নানা প্রান্তে শহীদ হন তরুণরা। গড়ে ওঠে শ্রমিক,কৃষকদের বড় বড় গণসংগ্রাম। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে চলতে থাকে নিরন্তর লড়াই। এরই প্রতিফলন পড়েছে নির্বাচনে। প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যাচ্ছে লা পাজে আরসে পেয়েছেন ৬৫ শতাংশেরও বেশি ভোট,কোচাবাম্বায় ৬৩ শতাংশ,ওরুরোতে ৬২ শতাংশ ভোট। প্রধানত গরিব ও শ্রমজীবী মানুষ ঢালাও ভোট দিয়েছেন এমএএস-কে ফিরিয়ে আনতে।
গত বছরের ২০ অক্টোবরের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হিসাবে ছিল অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস (ওএএস)। তারাই নির্বাচনে ‘জালিয়াতির’ অভিযোগ তোলে। কোনও অভিযোগই প্রমাণ করতে পারেনি। মার্কিন মদতে শুরু হয় রাস্তায় হাঙ্গামা। ওএএস নিজেই এই হাঙ্গামার পিছনে মদত জোগায়। এমনকি তারপরেও নতুন করে নির্বাচনে রাজি হন মোরালেস। ঠিক তার আগেই সামরিক বাহিনী মোরালেসকে সরে যেতে বলে। হিংসা আরও ছড়িয়ে পড়বে ভেবেই জনগণকে রক্ষা করতে আর্জেন্টিনায় চলে যান মোরালেস। দশ মাস পরেও জালিয়াতির অভিযোগের কোনও প্রমাণই দাখিল করতে পারেনি ওএএস। সেই ওএএস-ই এবার নির্বাচনে পর্যবেক্ষকের কাজ করেছে। এই ফলাফল হজম করা তাদের পক্ষে কঠিন। এমনকি রবিবারের স্পষ্ট ফলাফলের পরেও অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের ধারণা,ওয়াশিংটন ওএএস-কে দিয়ে নতুন কোনও ষড়যন্ত্র করতে পারে। নতুন রাষ্ট্রপতি হতে চলা লুইস আলবার্তো আরসে কাতাকোরা ‘লুচো’ বলেই পরিচিত। মোরালেস সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসাবে তিনি হাইড্রোকার্বন,টেলিযোগাযোগ,খনি জাতীয়করণের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মোরালেসের মতো তাঁর বিরুদ্ধেও ক্রুদ্ধ ছিল বহুজাতিক সংস্থাগুলি। দীর্ঘকাল ধরে লুণ্ঠিত বলিভিয়ার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন ৩৪৪ শতাংশ। চরম দারিদ্র্যের হার ৩৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে এনেছিলেন ১৫ শতাংশে। ব্রিটেনের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতকোত্তর আরসেকে দক্ষ অর্থনীতিবিদ বলে স্বীকার করে তাঁর প্রতিপক্ষও।