বাংলাদেশের নদী পরিস্থিতি, বন্যার প্রকোপ ও নদী সুরক্ষায় করণীয়

মো. আব্দুল মতিন

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
প্রাথমিক কথা: নদীমাতৃক বাংলাদেশ প্রধানতঃ গঙ্গা-বহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর পলিমাটি দিয়ে গঠিত একটি বদ্বীপ ভূমি। নদী শুধু আমাদের মাটি ও পরিবেশের শতকরা আশি ভাগের জন্মদাত্রীই নয়, অনাদিকাল থেকেই প্রতি মুহূর্তে নদীর পানি দ্বারাই আমাদের সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি, জীবন ও মানুষ সিঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু আজ সারা দেশের অবারিত পরিবেশ লুণ্ঠন ও দূষণ, ক্রমবর্ধমান আবহাওয়া-উষ্ণতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ব্যাপক জনসংখ্যা ও দারিদ্র্যের প্রেক্ষাপটে আমাদের নদীসমূহের অবস্থা কী? এক কথায় আমরা আজ ব্যাপক নদী বিপর্যয়ের শিকার। সার্বিক পরিবেশ বিপর্যয় আমাদের নদ-নদী, জলাশয়ের পানি হ্রাস, জলজ প্রাণী ও সম্পদ উজার তথা সার্বিক নদী বিপর্যয় যেন একসূত্রে গাঁথা, পরস্পরের সম্পূরক। আমরা জানি, নদী-নির্ভর বাংলাদেশ বন্যারও শিকার। বাংলাদেশ নদীবাহিত দেশ, বিভিন্ন কারণে আমাদের নদীগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে বলেই নদীর উপচে পড়া পানিতে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বন্যা আমাদের জন্য নতুন কোন বিষয় নয়, এটি নিয়মিত বিষয়। আর নদীতে পানি আসা মানেই আমাদের জন্য ক্ষতিকর বিষয় নয়, বরং আমাদের প্রকৃতি, ফসল ও নৌ-চলাচল নিশ্চিতকরণে প্রধান ইতিবাচক এক প্রক্রিয়া। আমাদের করণীয় হচ্ছে বন্যার পানি ব্যবস্থাপনার স্বার্থে নদীর যত্ন করা আর নদী বিনষ্টকারক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা। বন্যা ও ক্ষরা উভয় থেকেই আমাদের বাঁচার প্রধান ও মোক্ষম উপায় হচ্ছে নদীর যত্ন ও সংরক্ষণ নিশ্চিতকরণ। সাধারণভাবে নদীর অযত্ন-অবহেলা, নদীর ¯্রােত অন্যদিকে প্রবাহিত করা, নদীর ভেতরে অবকাঠামো স্থাপন প্রভৃতি কারণে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে ও বন্যা হচ্ছে, নদী বিনষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের নদ-নদীর অবস্থা: একাদশ শতাব্দিতে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার। নদী গুলো ছিল প্রশস্ত, গভীর ও পানিতে টই-টুম্বুর, বর্ষাকালে প্রমত্তা। আজ মোট নদীর সংখ্যা সর্বসাকুল্যে ২৩০ টি। গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও বরাক-মেঘনা নদী এবং তাদের উপনদী, শাখা নদী ও অন্যান্য সীমান্ত অতিক্রান্ত নদী মিলেই সারা বাংলাদেশের মূল নদী নেটওয়ার্ক গঠিত। আমাদের দেশে সীমান্ত অতিক্রান্ত নদীর সংখ্যা ৫৭ টি, যার ৫৪টি ভারত ও ০৩টি মিয়ানমারের মধ্যে প্রবাহিত। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বিগত এক দশক ধরে, বর্তমান নদীসমূহের মধ্যে ১৭টি নদী একেবারেই নদীর চরিত্র হারিয়ে, শুকিয়ে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- নরসুন্দা (কিশোরগঞ্জ), ভূবনেশ্বর (রাজবাড়ী-ফরিদপুর), বিবিয়ানা (হবিগঞ্জ), শাখা বরাক (হবিগঞ্জ), পালং (শরিয়তপুর), বুড়ি নদী (কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া), হরিহর (নোয়াখালী), মুক্তেশ্বরী (যশোর), হামকুমরা (খুলনা), মরিচাপ (সাতক্ষীরা), বামণী (লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালী), মানস (বগুড়া), বড়াল (নাটোর-পাবনা), চিকনাই (নাটোর-পাবনা), হিসনা (কুষ্টিয়া), মুসাখান (রাজশাহী-নাটোর) ও ভৈরব (কুষ্টিয়া-মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ-যশোর-খুলনা-বাগেরহাট)। আরো ৮টি নদী আজ বিপর্যস্তও মত্যুমুখী। এগুলো হচ্ছে- করতোয়া (পঞ্চগড়-বগুড়া-নীলফামারী-রংপুর-সিরাজগঞ্জ), ইছামতি (পাবনা-মানিকগঞ্জ-ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ), কালিগঙ্গা (কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ-মাগুরা-নড়াইল-পিরোজপুর), কুমার (কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ-মাগুরা-ফরিদপুর-মাদারীপুর), চিত্রা (নড়াইল-চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ), ভদ্রা (যশোর-খুলনা), সোমেশ্বরী (নেত্রকোনা) ও নবগঙ্গা (নড়াইল)। বাংলাদেশের সকল নদীর মধ্যে মাত্র ১০০ টির সাংবাৎসরিক নৌ-চলাচলের মতো প্রশস্ততা ও পানির গভীরতা রয়েছে। অর্থাৎ অধিকাংশ নদীই নাব্যতা হারিয়েছে। ১৯৭১ সনে আমাদের মোট নদীপথ ছিল ২৪টি, ১৪০০ কিলোমিটার আর নদীর পানির প্রবাহ কমে গিয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ ৩৮০০ কিলোমিটারে। নদীর প্রতি অবহেলা ও অত্যাচারের মাধ্যমে আমরা নৌ-পথের মতো সহজলভ্য, সস্তা, অধিক নিরাপদ, দৃষ্টিনন্দন ও আরামদায়ক পন্থাটিকে এই বেহাল অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছি। ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প চালু হলে আমাদের নদীগুলোতে প্রায় ৪০% ভাগ পানি প্রবাহ হ্রাস পাবে। ১৫-২০% প্রবাহ হ্রাস পেলেই আরো ১০০ টি নদীর সাংবৎসরিক নাব্যতা বিনষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের নদীসমূহে মোট প্রবাহিত পানির পরিমাণ ১০৭৪ বিলিয়ন ঘন মিটার। তার সাথে বৃষ্টির পানি এসে যুক্ত হয় ২৫১ বিলিয়ন ঘন মিটার। নদীগুলোর নাব্যতা রক্ষায় পানির প্রয়োজন হয় মোট ১৫০ বিলিয়ন ঘন মিটার। মাত্র ১০০টি নাব্যতাসম্পন্ন নদী নিয়ে ইতোমধ্যেই আমরা কতটা পানি সংকটে নিপতিত রয়েছি তা সহজেই অনুমেয়। নদী বিপর্যয়ের ধরণ ও প্রধান কারণগুলো নিন্মরূপ: ক. পানির প্রবাহ হ্রাস ও সীমান্তের বাইরের বাধা : শুষ্ক মওশুমে আমাদের দেশে ৯৭% ভাগ নদীর পানির প্রবাহ ও পরিমাণ হ্রাস পায়। ভারত থেকে আসা ৫৪ টি নদীর উজান অঞ্চলে (ভারতীয় অংশে) ভারত সরকারের নির্মিত বাঁধ/ব্যারেজ ও বিভিন্ন প্রয়োজনে পানি প্রত্যাহারমূলক কার্যক্রমই তার প্রধান কারণ। ‘ফারাক্কা’ ব্যারেজ আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী ধ্বংসের প্রধান কারণ। কয়েক বছর আগে ফারাক্কার উজানে গঙ্গা নদীর ওপরেই আরো ১৬টি ব্যারেজ বসানোর পরিকল্পনার কথা জানা গেছে। তার উপর ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে আমাদের গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে ১৭৩ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনাও ভারতের রয়েছে। উজানে ভারতের গাজলডোবা ও অন্যান্য বাঁধ এবং অন্য নদীর দিকে পানি সরিয়ে নেয়ার ফলে তিস্তা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমরাও আবার তৈরী করেছি তিস্তা ব্যারেজ। তিস্তা আজ বিপর্যয়ের মুখে। ভারতের মনিপুরের বরাক নদী নিচে এসে বাংলাদেশে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে প্রবাহিত হয়ে আবার যুক্ত হয়ে মেঘনা নদীর সৃষ্টি করেছে। মানুষের প্রতিবাদের মুখে বরাক নদীর উপর টিপাইমুখ ব্যারেজ নির্মাণের ভারতীয় পরিকল্পনা এখন স্থগিত রয়েছে। তবে বর্তমান ভারতীয় সরকার টিপাইমুখ ও আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প সম্পূর্ণ বাতিলের ঘোষণা দেয়নি। ১৫০০ মেগাওয়াট বিদুৎ উৎপাদনের জন্য টিপাইমুখ ড্যাম কোনদিন নির্মিত হলে বর্ষাকালেই মেঘনার পানি ৫ ফুট কমে যাবে। শীতকালের দুরাবস্থা সহজেই অনুমান করা যায়। টিপাইমুখ তৈরি ও চালু হলে সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনার সমুদ্রমুখী জল-প্রবাহ হ্রাস পাবে, সংশ্লিষ্ট অববাহিকার শুষ্কতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আমাদের উপকুলীয় ভূমি গঠন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সামুদ্রিক পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে আমাদের সমুদ্র-নিমজ্জন নিশ্চিত হবে। শীতকালে হাওরের জমিতে অনাকাক্সিক্ষত জলাবদ্ধতা থাকবে, বিদ্যমান প্রতিবেশের পরিবর্তন ঘটবে, জমির শুষ্কতার অভাবে বোর ফসলের পরিমাণ হ্রাস পাবে। উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি জনপদের ৭টি রাজ্যে ভারত ইতোমধ্যে ২৮টি বাঁধ/ব্যারেজ নির্মাণ ও চালু করেছে বলে জানা যায়, তাদের মূল পরিকল্পনায় - মোট ১৩৮-১৪৮ টি বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত ছিল, এগুলো বাতিলের কোনও কথা শোনা যায়নি। এই এলাকার পরিবেশ, জীবন-জীবিকার বিনিময়ে তারা উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোকে ‘পাওয়ার হাউজ’ এলাকা হিসেবে ব্যবহার করার কথা জানা গিয়েছিল, সে সিদ্ধান্ত বাতিলের কোন খবর আমরা এখনও জানি না। এসব হলে নিম্ন অববাহিকার বাংলাদেশের নদী ও পানির অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। এছাড়াও রয়েছে গণচীনের সাঙপু (ব্রহ্মপুত্র) নদীতে বাঁধ ও ইয়েলো নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এর পানি প্রত্যাহার জাতীয় দুঃসংবাদ। মিয়ানমার থেকে আগত তিনটি নদীর উপরও তাদের সরকারি অবকাঠামো রয়েছে। খ. পলি পতন : পলি জমে তলা ভরাট হয়ে বাংলাদেশের ১৮৭ টি নদী শুকিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, যা আমাদের মোট নদীর ২৮% ভাগ। প্রতি বছরে মোট নদীবাহিত পলির পরিমাণ ৩.৮ বিলিয়ন টন, যার মধ্যে ৪০-৪৫ টন নদীর তলায় জমা হয়। বাঙ্গালী, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, যমুনা, পদ্মা, তিস্তা নদী পলি জমাটের কারণে তাদের নাব্যতা হারাচ্ছে। আমাদের ৭৭% নদীর মুখে পলি জমে পানি প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। মুখ Ÿন্ধ হয়ে যাওয়ার শিকার নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে- মেঘনা, ফেনী, মুহুরী, কর্ণফুলী, বাকখালী, তেতুলিয়া, ইলিশা, আন্দারমানিক, পায়রা, লোহালিয়া, রায়মঙ্গল, আরপাং, শিবসা, পশুর ও সুন্দরবনের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ও উপনদীসমূহ। ৭৬% নদীতে পলি জমার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। গ. নদীভাঙন : বাংলাদেশের ৪১% নদী ব্যাপক ভাঙনের শিকার। বিশেষ করে বর্ষাকালে আড়িয়াল খাঁ, বলেশ্বর, ধলেশ্বরী, ধরলা, মেঘনা, যমুনা, পদ্মা প্রভৃতি নদীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভাঙনের কবলে পতিত হয়। পাড় ভাঙা মাটি নদীর তলা ভরাট করছে অবিরত। ঘ. বেষ্টনী স্থাপনা (ঈড়ৎফড়হ ঝঃৎঁপঃঁৎব) : বিগত ৬০ বছরে সরকারি পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে ৫(পাঁচ) শতাধিক বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ৩৫ মিলিয়ন হেক্টর জমিকে নদীর পানি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ফলে তাদের উর্বরতা কমার পাশাপাশি বাঁধের বাইরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। প্রয়োজনের সময় আশেপাশের পানি নদী না পাওয়াতে তাদের পানি প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে; বৃদ্ধি পেয়েছে পলি পতন। বেষ্টনী স্থাপনা যেমন- বাঁধ, ব্যারেজ, পাড় বাঁধাই নদী প্রবাহ ব্যাহত করার জন্য প্রধান কারণ হিসেবে প্রমাণিত। যুক্তরাষ্ট্রের পর ভারত ও চীনই সর্বোচ্চ সংখ্যক বাঁধ তৈরির দেশ। এ দুই দেশের মোট বাঁধ পৃথিবীর সর্বমোট বাঁধের ৫৫% ভাগ। বাঁধের জন্য সৃষ্ট নদী, পানি ও পরিবেশ দুর্যোগের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ইতোমধ্যে ৫০০ বাঁধ অপসারণ করা হয়েছে। উপমহাদেশের বাঁধপ্রীতি এখন প্রবল। বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে বাঁধ (রাবার ড্যামসহ) তৈরির মাধ্যমে যেসব নদীকে ক্ষতিগস্থ করা হয়েছে সে গুলো হচ্ছে - বড়াল, ধনগোদা, ফেনী, গড়াই, হালদা, কপোতাক্ষ, মনু, মেঘনা, মহুরী, তিস্তা ও গোপলা। ছোট নদীগুলোর ওপর মাটির বাঁধ নির্মাণ সারাদেশের অনেক নদীতেই হয়েছে ও হচ্ছে। রাজশাহীর চারঘাটায় পদ্মা থেকে সৃষ্ট বড়াল নদীর উৎসমুখ, আটঘড়িয়া ও চাটমোহরে মোট তিনটি রেগুলেটর স্থাপন এবং চাটমোহরে মাত্র দুই কিলোমিটারের মধ্যে মোট তিনটি ক্রস-বাঁধ দিয়ে বড়াল ধ্বংস করা হয়েছে। মানুষের প্রতিবাদের মুখে মাটির বাঁধ অপসারণ করা হলেও করোনা সংকটের সুযোগে আবার স্থানীয় প্রভাবশালীরা একটি মাটির বাঁধ তৈরি করেছেন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিরাট এলাকা আজ বাঁধজনিত জলাবদ্ধতার শিকার, অথচ আবার নতুন করে যশোর-কুষ্টিয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজারে গোপলা নদীর উপর রাবার ড্যাম ব্যাপক এলাকার কৃষি আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর মোহনার চর অপসারণ না করে সেখানে ম্যানগ্রোভ বন স্থাপন করা হচ্ছে। এরকম অসংখ্য তথ্যে ভরা আমাদের গত ১৪ বছরের বার্ষিক নদী-প্রতিবেদন। পানি উন্নয়ন বোর্ড, এলজিআরডি, জেলা পরিষদ কর্তৃক নির্মিত এই বাঁধ নির্মান ও বাণিজ্য উৎসবে সারা দেশের অসংখ্য নদী আজ সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখোমুখি। এবার সর্বশেষ অনুষঙ্গ হিসেবে যোগ হতে যাচ্ছে বিদেশি উপদেষ্টা ও অর্থায়ন পুষ্ট বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ - যা বাংলাদেশের বাকি নদী কয়টির জন্য এক পরিষ্কার অশনিসংকেত! কারণ দেশীয় প্রযুক্তি-প্রকৌশল বিশেষজ্ঞদের যুক্ত না করে ও দেশবাসীকে অন্ধকারে রেখে নেদারল্যান্ডসের বদ্বীপ ব্যবস্থাপনা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, তাদের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, পরিকল্পনা ও অর্থায়নে এর প্রথম পর্যায়ের কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের দেশের নদী বিপর্যয়ের পুরাতন বিষয়াদি যেমন ষাটের দশকের বন্যা বিরোধী ক্রুগ মিশন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৌশলী সংস্থা ‘আইইসি’’র পরিকল্পনা, সবুজ বিপ্লবের ডাক, আশির দশকের বিশ্বব্যাংকের বুদ্ধিতে পানি উন্নয়নের বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা - এসব কিছুই ছিল বাঁধ-পোল্ডার ভিত্তিক নদী ধ্বংসাত্নক কার্যক্রম, যার কুফল আজ আমরা ভোগ করছি। অথচ নতুন বদ্বীপ পরিকল্পনাতেও সেই একই নদী-পরিবেশ বিনাশী নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ঙ. নদী দখল : দখলজনিত কারণে দেশে ১৫৮ টি প্রশস্ত নদী আজ ক্ষীণকায় হয়ে পড়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ, বংশী (টঙ্গী), কালিগঙ্গা (মানিকগঞ্জ), ভৈরব, চিত্রা, কপোতাক্ষ ও নবগঙ্গা (যশোর), নরসুন্দা ও কলাগাছিয়া (কিশোরগঞ্জ), সুরমা (সিলেট) ও কর্ণফুলী (চট্টগ্রাম)। কয়েক বছর পূর্বে আশুগঞ্জে জনৈক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তির ঘনিষ্ট এক আত্মীয় একটি প্লাস্টিক কারখানা নির্মাণের জন্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী ‘মেঘনা’ ও অভ্যন্তরে প্রায় চারশত ফুট স্থানে মাটি ভরাট করেছিল। বাপা’র আন্দোলন ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নির্দেশের ফলে তা শেষ পর্যন্ত অপসারিত হয়। বর্তমানে হবিগঞ্জের সোনাই নদীর মধ্যখানে ‘নিজস্ব জমিতে’ নির্মিত হয়েছে একজন রাজনৈতিক দখলদারের বহুতল বিশিষ্ট ভবন। নদীর ভিতরে জাজ্বল্যমান এই ভবনের মাথা উঁচু হচ্ছে প্রতিদিন, কিন্তু সরকারি প্রশাসন এমনকি শেষ পর্যন্ত জাতীয় নদী রক্ষা টাস্কফোর্স এই ভবনটিকে ‘নদীর বাইরে’ বলে প্রত্যায়ন করেছিল। জাতীয় নদী কমিশন গঠিত হওয়ার পর প্রথমে এই ভবনটিকে নদীর বাইরে বলে সত্যায়িত করলেও, কমিশনের বর্তমান প্রধান এটিকে নদীর দখলদার হিসেবে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তাতে ভবন তৈরির কাজ বন্ধ হয়নি। নদীর জমি চিহ্নিতকরণ ও নদীর পাড় সংরক্ষণে বিদ্যমান পরিষ্কার আইনি বিধানকে না মানা, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও দুর্ণীতি, প্রভাবশালী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বেআইনি ভোগ-দখল-সংস্কৃতি, ভূমি মন্ত্রণালয়ের আইন বহির্ভূত নদীর জমি লিজ প্রদান চর্চা প্রভৃতি নদী দখল ও বিনষ্টের প্রধান কারণ। চ. পরিবেশ বিপর্যয় : সীমান্ত অতিক্রান্ত নদীগুলোর প্রবাহ পথে ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে ব্যাপক পরিবেশ দূষণ, পানি দূষণ, গাছ কাটা, গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া, পাহাড় কাটা, পাহাড়ি নদীতে এক্সক্যাভেটর মেশিনে অপরিকল্পিত যথেচ্ছ পাথর উত্তোলন (জাফলঙ এর পিয়াইন, ডাউকি, ভোলাগঞ্জের ধলাই নদী), পাহাড়ি বনে জনবসতি বৃদ্ধি (বাঙ্গালী, রোহিঙ্গা) ও তামাক চাষ (চকোরিয়ায় মাতামুহুরী নদী), উন্নয়ন কার্যক্রম, উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়ে কালাপাহাড় কেটে অবারিত কয়লা উত্তোলন ও এ কারণে ব্যাপক কয়লার ময়লা ও পাথর-নুড়ি মিশ্রিত পানির ঢল (সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের যাদুকাটা নদী), বোল্ডার নিক্ষেপ (ব্রহ্মপুত্র নদ ও যমুনা নদী), বিল-হাওর-বাওর বিপর্যয় (চলনবিলের মধ্যস্থিত ০৯টি নদী ও ১৭টি খাল), প্রভৃতি বিষয়ও আমাদের নদী বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। সারা বিশ্বের মত উপমহাদেশের আবহাওয়াও ক্রমশই উষ্ণতা লাভ করছে। ফলে হিমালয়ের বরফ গলার হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাড়ছে বন্যার প্রকোপ, ভাঙছে নদীর পাড়, জমছে আরো পলি মাটি। এসব কিছুর প্রান্তিক ফলাফল হচ্ছে আমাদের নদী ভরাট ও মৃত্যু। ছ. রাসায়নিক দূষণ : দেশের ১১ ভাগ নদী শিল্প বর্জ্য নিঃসৃত রাসায়নিক দ্রব্য দ্বারা ব্যাপক দূষণের শিকার। নদী দূষণের প্রধান কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে, শিল্প-কারখানার বর্জ্য; শহুরে বর্জ্য, পলিথিন ব্যাগ, প্লাষ্টিক দ্রব্যাদি; রাসায়নিক সার, কীটনাশক দ্রব্য, নৌ-যান নিঃসৃত ময়লা, বর্জ্য ও তেল; বেআইনি দীর্ঘস্থায়ী জৈব দূষণ পদার্থ; দখলদারদের বর্জ্য; হাসপাতাল বর্জ্য; মানুষ ও পশু-পাখির মল-মূত্র, মৃতদেহ; নদীভাঙনের মাটি; গাছ-গাছালির পাতা ও কচুরিপানা; ভাঙা নৌযান, মাছ ধরা ও নির্মান সামগ্রী ইত্যাদি। আমাদের দেশে কলকারখানাগুলো থেকে নানা রকম দীর্ঘস্থায়ী বিষাক্ত তরল দূষক পরিবেশের সীমাহীন ক্ষতি সাধন করে চলছে। দূষণকারী কলকারখানার মধ্যে ট্যানারি, ইউরিয়া ও টিএসপি কলকারখানা, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ও পেপার মিল, ফেব্রিক মিল, ওষুধ কারখানা, ব্যাটারি তৈরির কারখানা, ডিটার্জেন্ট ফ্যাক্টরি, ইত্যাদি অন্যতম। এ সমস্ত কারখানা থেকে বিষাক্ত কেমিক্যাল, এসিড, এলকালি, হেভি মেটাল, নানারকম রঞ্জক পদার্থ শুধু উপরিভাগের জলরাশি নয় ভূগর্ভস্থ পানিকেও দূষিত করে তুলছে। সারাদেশে নিবন্ধিত ২৭৭টি চামড়া শিল্প থেকে প্রতিদিন ৮.৪৭ মিলিয়ন লিটার তরল বর্জ্য নিষ্কাষিত হয়। তার ৯০ ভাগ কারখানাই ছিল ঢাকার হাজারীবাগে, কিছু ট্যানারি স্থানান্তরের পরও বুড়িগঙ্গা সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত হয়নি, বরং সাভার ট্যানারিতে ধলেশ্বরী নদী এখন দূষিত হচ্ছে যা আবার বুড়িগঙ্গায় গিয়ে মিশছে। আমরা জানি, ক্রোমিয়াম মিশ্রিত তরল বর্জ্য মাছের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে। ডায়িং কারখানা থেকে বিষাক্ত রঞ্জক পদার্থ প্রাণীকূলের নানা রকম রোগ বৃদ্ধিসহ খাদ্য চক্রের বিষক্রিয়া প্রভাব বৃদ্ধি করছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ঢাকার চারপাশের নদী-খালসমূহের ওপর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০০৮ সালে প্রণীত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এসব নদীদূষণের প্রধান কারণ শিল্প-কারখানার বর্জ্য (৬০%), তারপর হচ্ছে ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য (৩০%)। কিন্তু তা এখনও বন্ধ হয়নি, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীর বর্জ্য নদীর তলা ভরাট করে, পানি ধারণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় ও বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি করে। (চলবে) লেখক: নির্বাহী সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা); সমন্বয়কারী, জাতীয় নদী রক্ষা আন্দোলন

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..