সব হিসাব আছে শুধু শ্রমিকের জীবনেরটা নেই

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
একতা প্রতিবেদক : করোনাভাইরাসের সংক্রমণে গোটা দুনিয়াই এখন কাঁপছে। এই রোগ থেকে বাঁচতে মানুষকে যতোটা সম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে ঘরে থাকার কথা বলা হচ্ছে। গণপরিবহন এড়িয়ে চলার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষ, শ্রমিকশ্রেণি যার নিজের নিরাপদে থাকার কোনো ঘর নেই, প্রতিদিন কাজ না করলে যা সংসার চলে না, বাধ্য হয়েই যাকে প্রতিনিয়ত গণপরিবহন ব্যবহার করতে হয়- তাঁর জীবনের নিরাপত্তা কতটুকু? এই দেশের বিশাল শ্রমিকশ্রেণি যে করোনাভাইরাসের কারণে এক বিরাট ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সেটা যেন রাষ্ট্র ভাবছেই না। বরং গণমাধ্যমে খুব বড় করে আসছে, তৈরি পোশাক শিল্প কয় টাকার ক্রয়াদেশ হারিয়েছে, বছর শেষে ব্যবসায় কতটুকুক্ষতি হতে পারে, সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের কীভাবে তৈরি পোশাক মালিকদের পাশে দাঁড়ানো উচিত- এই সব হিসাব হয়ে গেছে। কিন্তু করোনভাইরাস মহামারী আকারে দেখা দিলে, বস্তিতে থাকা গার্মেন্ট শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, পরিবহন শ্রমিক, গৃহকর্মী, নিন্মবিত্ত-শ্রমজীবী মানুষের কী হবে, তাঁরা কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তাঁরা কীভাবে জীবন রক্ষা করবেন শুধু সেই হিসাবই কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ছাড়াও বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিকের জীবনযাত্রায়ও প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। আইএলও তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক ও শ্রম সংকটে নতুন করে যুক্ত হতে পারে আরো আড়াই কোটি মানুষের বেকারত্ব। ‘কভিড-১৯ এবং ওয়ার্ল্ড অব ওয়ার্ক: ইম্প্যাক্ট অ্যান্ড রেসপন্সেস’ শীর্ষক আইএলওর প্রাথমিক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ১৮ কোটি ৮০ লাখ। করোনার প্রভাব পর্যালোচনার মাধ্যমে আইএলও মনে করছে বৈশ্বিক জিডিপিতে এটির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক ও শ্রম সংকটে নতুন করে যুক্ত হতে পারে আরো আড়াই কোটি মানুষের বেকারত্ব। আইএলও জানিয়েছে, এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কাজের সময় ও মজুরি হ্রাসের কারণে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, যা অর্থনীতির ওপরও পড়ছে। চলাচল সীমিত হওয়ায় উন্নয়নশীল দেশগুলোয় কর্মসংস্থানে এরই মধ্যে এটির প্রভাব পড়েছে। আইএলও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর তুওমো পৌতিয়াইনেন বলেন, বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের ক্রয়াদেশ এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তো রয়েছেই। এ ভাইরাস একই সঙ্গে প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিকের অর্থনৈতিক অবস্থা ও জীবনযাত্রায়ও প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিশাল অনানুষ্ঠানিক খাতকে ভুলে গেলে চলবে না। স্থবির হয়ে গেছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ড। বয়স্ক কর্মীদের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি রয়েছে ছাঁটাই হওয়ার ভয়। অন্যদের জন্যও কর্মক্ষেত্র হয়ে উঠছে সংকুচিত। অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি পরিবারের কাছে যাওয়ার সুযোগও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির এই বিরাট ধাক্কা প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে শ্রমবাজারে। এ সংকটে আইএলও বাংলাদেশ তাদের অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। আইএলও মনে করে, করোনার প্রভাব পড়বে বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে। যেহেতু কর্মঘণ্টা কমে যাচ্ছে বা যাবে, তাই আয় কমে যাবে। অনেক কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে বেকারত্ব বাড়বে। তৈরি হবে কর্মসংস্থানগত দারিদ্র্য। মানুষের হাতে অর্থ না থাকলে কমবে তাদের ক্রয়ক্ষমতাও। পরিশেষে একটি শ্রেণী দারিদ্র্যসীমার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছবে। কর্মক্ষেত্রে দারিদ্র্যে নতুন করে যুক্ত হবে ৯০ লাখ থেকে সাড়ে তিন কোটি মানুষ। সবচেয়ে ঝুঁকিতে কী বস্তিবাসী?: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোকগণনা তথ্যমতে, দেশে এখন বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩৫। বস্তিবাসী ও ভাসমান খানা রয়েছে ৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৬১টি। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৭৫৬টি। পৌরসভা এলাকায় আছে ১ লাখ ৩০ হাজার ১৪৫টি। ৩২ হাজার ৯৬০টি রয়েছে অন্যান্য শহর এলাকায়। এই বিশাল বস্তিবাসী কোনো সামাজিক নিরাপত্তা ছাড়াই ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকেন। একটি ঘরে হয়তো চার থেকে পাঁচজন করে মানুষ থাকেন। আলাদা ঘর বলতে শুধু আড়াল আছে, কিন্তু সেটাকে কোনোভাবেই নিরাপদ বা নিরাপত্তা বলা যায় না। ছোট ছোট টিনের ঝুপড়ির মধ্যে লাখ লাখ মানুষ বসবাস করছে। একজন কোনো কারণে সংক্রামিত হলে গোটা বস্তিতেই ছড়িয়ে পড়তে পারে সেই ব্যাধি। এই বিরাট ঝুঁকি এড়াতে রাষ্ট্র কী কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে? না নেয়নি। এই বিরাট বস্তিবাসীর একটা বিরাট অংশই অসচেতন, যাদের করোনাভাইরাস নিয়ে কোনো ধারণাই নেই। ফলে বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে অনিরাপদে বা ঝুঁকির মধ্যে রেখে গোটা দেশকে কী এর বিপদ থেকে রক্ষা করা যাবে- এই প্রশ্নও উঠেছে বিশেষজ্ঞ মহল থেকে। করোনাভাইরাসের মোকাবেলায় সবার ক্ষেত্রেই সমান নীতি গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করেন তারা। আর শ্রমিকদেরকেও নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার কথাই প্রথমে ভাবতে হবে। নিজেদের জীবনের নিরাপত্তায় যে কোনোভাবেই কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য নিজেদের মধ্যে একতাবদ্ধও থাকতে হবে। বাংলাদেশের জন্য কঠোর সতর্কবার্তা: দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় জন্য কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটির মতে, পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। ভাইরাস যেন আরো মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে না পারে তা নিশ্চিত করতে আমাদের অতি দ্রুত কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এটি প্রতিহত করতে যে আমাদের আরো জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে সেটিও স্পষ্ট।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..